লাহা পরিবারের দুর্গাপূজা।। সুস্মেলী দত্ত

অনেকে মনে করেন লাহা পরিবারের দুর্গাপূজা দীর্ঘ সাড়ে তিনশো বছরের পুরোনো। বরশূল নিবাসী বনমালী লাহা প্রথম এই পূজার প্রচলন করেন। কেউ বলেন, মহানন্দ লাহা কর্জনা নগরে প্রথম দুর্গাপূজার পত্তন করেন। সেই হিসেব করলে লাহা পরিবারের দুর্গাপূজা ধরা হবে প্রায় আটশ বছরেরও বেশি পুরোনো।

তবে যতদূর লিখত প্রমাণ পাওয়া যায়, প্রায় আড়াইশো বছরেরও আগে মধুমঙ্গল লাহা চুঁচুড়ায় একচালচিত্রে প্রথম দুর্গাপূজা করেছিলেন। তারপর চুঁচুড়া থেকে কলকাতায় এসে দুর্গাচরণ, শ্যামাচরণ, শ্রীকৃষ্ণ লাহা ও ভগবতীচরণ লাহা বেচু চ্যাটার্জী স্ট্রীটের বাড়িটি কিনে প্রথম সেখানে দুর্গাপূজার প্রচলন করেন।

একমাত্র দুর্গাই মূর্তি হিসেবে লাহাবাড়িতে পূজিত হন। কারণ, অনেকে মনে করেন, দুর্গা আসলে লাহাবড়ির আরাধ্য কুলদেবী শ্রীশ্রী জঁয় জঁয় মা–ই। মা আসলে প্রতীকী হিসেবে প্রতি আশ্বিনে মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তিতে প্রাণ পান। যদিও কুলদেবীর মূর্তিটি অষ্টধাতুর তৈরি এবং সিংহবাহিনী মূর্তি। কথিত আছে, বহুকাল আগে, ডাকাতেরা সোনার মূর্তি ভেবে এই অষ্টধাতুর মূর্তিটি কোনও জায়গা থেকে চুরি করে। পরে, ভুল ভাঙায় তারা এই বিগ্রহটি একটি জঙ্গলের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। কোনও এক লাহাগিন্নী স্বপ্নে সেই দেবীমূর্তি দর্শন করেন ও তাঁকে উদ্ধার করার ব্যবস্থা করেন। কেউ কেউ বলেন, মূর্তিটি জঙ্গলে নয়, পদ্মা নদীর গর্ভে নিমজ্জিত ছিল।

যাহোক, মোটের ওপর এই কুলদেবীকে সাক্ষী রেখেই লাহা পরিবারের দুর্গাপূজা সম্পন্ন হয়। মধুমঙ্গল লাহার পরবর্তী প্রজন্ম প্রাণকৃষ্ণ, নবকৃষ্ণ ও শ্রীকৃষ্ণ লাহার উত্তরসূরীরা যথাক্রমে বড়, মেজ ও ছোটদের ঘর – এভাবে পালা অনুসারে দুর্গাপূজা করে থাকেন। যে বাড়িতে মায়ের পূজার পালা পড়ে, সেখানে মা অর্থাৎ কুলদেবী জঁয় জঁয় মাতা টানা একবছর থাকেন। সেই বাড়িটিই তখনকার মতো লাহাপরিবারের সদস্যেরা ঠাকুরবাড়ি হিসেবে মেনে নেয়। সেখানে লক্ষ্মী পুজো, নারায়ণ পুজো, রথ, রাসপূর্ণিমা, হরেক ব্রত প্রভৃতি তখন ঠাকুর ঘরেই হয়ে থাকে। বলা বাহুল্য দুর্গাপুজো ছাড়া সমস্ত লাহাপরিবারে কোনরকম মূর্তিপূজা হয় না। বিসর্জনের দিন দুর্গা ঠাকুরের কাঠামোটি জলে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তুলে নেওয়া হয়। মাটি ধুয়ে গেলে কাঠামোটির স্থান হয় নির্দিষ্ট ঠাকুরদালানে। একবছরের মাথায় রথের দিন কাঠামোটি পরবর্তী সময়ে যে বাড়িতে পুজো হবে অর্থাৎ পরবর্তী পালাকারের বাড়িতে স্থানান্তরিত করা হয়। প্রতিবছর দোসরা আশ্বিন তারিখে জঁয় জঁয় মা আবার পরে যাঁর বাড়িতে দুর্গাপূজা হবে, তাঁর বাড়িতে ওঁকে স্থানবদল করানো হয়। এর মাঝখানে জন্মাষ্টমীর পরের দিন অর্থাৎ নন্দোৎসবের দিন কাঠামো পুজা হয়, যেখানে একটি ছোট মাটির গণেশকে পূজো করা হয়, যে গনেশটিকে পরবর্তীকালে মূর্তি গড়ার সময় গণেশঠাকুরের পেটের ভিতর চুকিয়ে দেওয়া হয়। এদিন প্রথম কাঠামোর গায়ে মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়। কুমোর একজন নির্দিষ্ট থাকেন, যাঁকে বংশানুক্রমিকভাবে লাহাদের প্রতিমা গড়ার ভারটি দেওয়া হয়। ছাঁচ একই – যে কারণে একচালা মা দুর্গা তাঁর সন্তানসন্ততি সহ শিবদুর্গার এই মূর্তিটি প্রতিবছর একই ধরনের হয়। মোটের ওপর, এই দুর্গাপূজাটি ঠিক যেভাবে যে নিয়মে শুরুর সময় নির্ধারিত হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই অবিকল একই নিয়ম কানুন অনুসরণ করে, ঐত্যিহ্যের ধারাটি অবিকৃত রেখে এই একবিংশেও তার ধারাবাহিকতা বজায়  রাখতে সক্ষম হয়েছে। লাহা পরিবার এ ব্যাপারে তাঁদের চেষ্টায় কসুর করেননি।

নির্দিষ্ট শুদ্ধাচারী রান্নার ঠাকুরকে দিয়ে আলাদা একটি স্থানে রান্নাবান্না করানো থেকে শুরু করে সপ্তমীর দিন সকালে কলাবৌ স্নান, ষষ্ঠীতে বোধন, মায়ের চক্ষুদান পর্ব প্রভৃতি বিভিন্ন কার্যকলাপে রীতি নীতি মানার এই সুষ্ঠু রেওয়াজটি সত্যি চোখে পড়ার মতো।

বিভিন্ন রকম নাড়ু যেমন – চুম্বের নাড়ু, নারকেল নাড়ু, তিলের নাড়ু, মুগের নাড়ু, ছোলার নাড়ু, বুটের নাড়ু, মুড়ির মোয়া, খইয়ের মোয়া, বেলা পিঠে, জিবে গজা, পান গজা, ছোট গজা, চৌকো গজা, চিরকূট গজা, প্যারা কি, চিনির মুড়কি, মোয়া প্রভৃতি নানাবিধ মিষ্টি (ঘরের তৈরী) ফল, লুচি, কচুরী, বেগুন–আলুভাজা, কুমড়োর ছোঁকা, ফুলুড়ি, বেগুনি, পটলভাজা, আলুভাজা, বেগুনভাজা, ডাবের জল প্রভৃতি বিবিধ রকম খাদ্য সামগ্রী ভোগের জন্য দেওয়া হয়। অন্নভোগ হয় না।

পূজোর ক’দিন লাহাপরিবারের সকলেই নিরামিষ খান। অষ্টমী বাদে অন্যান্য দিন (ষষ্ঠী, সপ্তমী, নবমী) ভাত, কড়াইয়ের ডাল, পাঁচরকম ভাজা, সুক্তো প্রভৃতি হয়। অষ্টমীর দিন ভাত খাওয়া হয় না। দশমীর দিন জঁয় জঁয় মা ঠাকুরঘরে উঠে গেলে আমিষ খাবারের আয়োজন করা হয়। সেদিন মাংস বাদে আমিষ নানান পদ (মাছের) ভাত, মিষ্টিসহ সকলে লাহা পরিবারে আত্মীয় পরিজন বন্ধুসহ একযোগে বসে খান। যিনি পালাকার, ব্যয়ভার মূলত তাঁরই থাকে।

এবার আসি, দু একটি পূজোর নিয়মকানুন সম্পর্কে আলোচনায় – প্রথমত, লাহা পরিবার বৈষ্ণবমতে পূজায় বিশ্বাসী, তাই শশা ও ছাঁচিকুমড়ো ছাড়া এখানে কোন বলি হয় না দ্বিতীয়ত, ধুনো পোড়ানো নামক একটি নিয়ম আছে, যেটি অষ্টমী ও সন্ধিপূজার সময় করা হয়। মূলতঃ বিবাহিত মহিলারাই এটি করে থাকেন। মাথায় ভিজে গামছা দিয়ে নতুন কাপড় পরে বিবাহিতা মহিলারা সার সার বসেন দালানে। মাথায় ও দুহাতে থাকে মাটির সরা। কর্পূর, দূর্বা প্রভৃতির সাহায্যে আগুন জ্বালিয়ে মাত্র কয়েকসেকেন্ডের জন্য তাঁরা তাঁদের মানসিক ইচ্ছা ও সংকল্পকে স্মরণ করে ধুনো পোড়ান। এর ফলে তাঁরা মায়ের কৃপায় পবিত্র হয়ে ওঠেন। এরপর হয় কুমারীপূজা। ব্রাহ্মণ অবিবাহিত কন্যাকে তাঁরা দুর্গার প্রতীকী হিসেবে পূজা করেন।

তৃতীয়ত; দশমীতে বিসর্জনের পরেপরেই বাড়ির গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়, যতক্ষণ না কাঠামোটি ফিরে আসে। ফিরে এলে বাইরে থেকে প্রশ্নকর্তা ‘মা আছেন’ বলে তিনবার প্রশ্ন করেন। উত্তরদাতা হ্যাঁ বললে তবেই ভেতরে সকলের প্রবেশের অধিকার মেলে। আসলে, লাহাপরিবার বিশ্বাস করে, মা দুর্গা তাঁদের ছেড়ে কোনসময়ই যান না। বিসর্জন প্রতীকীমাত্র, আসলে জঁয় জঁয় মা, মা দুর্গার রূপে সারাক্ষণ, সারাজীবন তাঁদের সঙ্গেই থাকে।

কথিত আছে, একবার ভুলবশতঃ সদর দরজা বন্ধ করায় কোন একজন লাহা গিন্নী প্রত্যক্ষ করেন যে, একজন সালঙ্কারা ছোট্ট মেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। ওঁর তৎপরতায় তৎক্ষণাৎ গেটটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

লাহা পরিবারের সকলে বিশ্বাস করেন যে, আজ যে জায়গায় ওঁরা দাঁড়িয়ে আছেন তা সাবই কুলদেবীর আশীর্বাদে। তাই মা দূর্গার হয়ত শারীরিকভাবে বিসর্জন যদি বা হয়েও যায়, কিন্তু জঁয় জঁয় মা সারাজীবন, সারাবছর, মৃত্যু অবধি ওঁদের সুরক্ষিত রাখেন। তাই সমগ্র দুর্গাপূজাটাই ওঁদের কাছে প্রতীকী, আসল হল মা সিংহবাহিনী নামক শক্তির আরাধনা।

দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে লাহাবাড়ির সদস্যরা একত্রীভূত হয় অন্ততঃ বছরে একবার। তাইতো শিবদুর্গার সন্তানসন্ততিতের নিয়ে আগমনের এই পারিবারিক মূর্ত্তিটির মধ্য দিয়ে, ওঁরা সমাজে যৌথ জীবন ও যাপনকে দৃষ্টান্ত স্বরূপ করে রাখেন।

আজ যখন মানুষ মানুষে এত ভেদাভেদ, পারিবারিক কলহ, ঈর্ষা, স্বার্থপরতা, অহংবোধ ইত্যাদি ইত্যাদি নঞর্থক শক্তি সেখানে অবশ্যই সমগ্র লাহা পরিবার তাঁদের এই পূজার মধ্য দিয়ে ঈশ্বর পূজা তো বটেই, মানব মনের প্রসারতার পথটিও বোধহয় পরোক্ষভাবে সুগম করার বার্তা বহন করে। তাই তো আড়াইশো বছর আগেকার এই ঐতিহ্য আজও এই যুগেও সময়োপযোগী ও ভালো থাকার নির্দশন। আমি এই পরিবারের কন্যা হিসেবে তাই আজও গর্ববোধ করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published.