কালের স্রোতে দুর্গাপুজো ।। তন্ময় মণ্ডল

আজ দুর্গাপুজো উৎসবপ্রিয় বাঙালীর কাছে শ্রেষ্ঠ উৎসব। আজকের দিনে এটা কোনও নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বী মানুষের উৎসব নয়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালীর মেতে ওঠার কয়েকটা দিন। তবে আজকে যে দুর্গাপুজো আমরা দেখি তা কালের স্রোতে বদলে যাওয়া সময়ের রূপরেখা মাত্র। শুরুর সময়ে এই পুজোর এমন রূপ ছিল না। দুর্গাপুজো কবে, কখন, কোথায় প্রথম শুরু হয়েছিল তা নিয়ে নানা মতভেদ আছে। দূর্গোৎসবের কালক্রমিক ইতিহাস সম্পর্কিত সুস্পষ্ট তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়না। ফলে কখন, কীভাবে দূর্গোৎসব শুরু হল তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তবে পূরাণ, মহাভারত, রামায়ন, ধর্মীয় কাব্য, নানা ঐতিহাসিক গ্রন্থ ও সূত্র থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।

ভারতবর্ষের দক্ষিণ দিকে দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন ছিল। আর্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবতাদের। অনার্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবীদের, তারা পূজিত হতেন আদ্যাশক্তির প্রতীক রূপে। মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের গঠন, দায়িত্ববোধ ও উর্বরতা শক্তির সমন্বয়ের কথা বিবেচনা করে অনার্য সমাজে গড়ে ওঠে মাতৃপ্রধান দেবী সংস্কৃতির ধারনা।

ভারতে অবশ্য মাতৃরূপে দেবী সংস্কৃতির ধারনা অতি প্রাচীন। ইতিহাস থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, প্রায় ২২,০০০ বছর আগে ভারতে প্যালিওলিথিক জনগোষ্ঠী থেকেই দেবীপুজোর প্রচলন হয়েছিল। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতা তথা সিন্ধু সভ্যতায় এসে তা আরো গ্রহণযোগ্য, আধুনিক ও বিস্তৃত হয়। শাক্ত মতে, কালী বিশ্ব সৃষ্টির আদি কারণ। অনান্য দেব-দেবী মানুষের মঙ্গলার্থে তাঁর বিভিন্ন রূপে প্রকাশ মাত্র।

আবার মহাভারতের ধারণা অনুসারে, দূর্গা বিবেচিত হন কালী শক্তির আরেক রূপে। নানা অমিল ও বৈচিত্র থাকা সত্বেও কীভাবে কালী, দূর্গার রূপের সাথে মিশে এক হয়ে গেল সে রহস্য আজও অজানা। কেউ কেউ ধারনা করেন, সিন্ধু সভ্যতায়  দেবীমাতা, ত্রিমস্তক দেবতা, পশুপতি শিবের পূজার প্রচলন ছিল। আর দূর্গা শিবের অর্ধাঙ্গিনী। সেই হিসাবে অথবা দেবী মাতা হিসাবে তার পুজো হতে পারে।

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে, দুর্গাপুজোর প্রথম প্রবর্তক কৃষ্ণ, দ্বিতীয়বার দুর্গাপুজো করেন স্বয়ং ব্রহ্মা আর তৃতীয়বার পুজোর আয়োজন করেন মহাদেব। আবার দেবী ভাগবত পুরান অনুসারে জানতে পারা যায়, ব্রহ্মার মানস পুত্র মনু ক্ষীরোধ সাগরের তীরে দূর্গার আরাধনা করে বর লাভে সফল হন। মূল বাল্মীকির রামায়ণে, দুর্গাপুজোর কোন অস্থিত্ব নেই। কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়নে দুর্গাপুজোর অস্তিত্ব আছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণ-এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, এটি মূল রামায়ণের আক্ষরিক অনুবাদ নয়। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী কবি কৃত্তিবাস ওঝা সংস্কৃত রামায়ণ বাংলা করার সময় মূল রামায়ণের বাইরের তৎলালীন সমাজে প্রচলিত বাংলার সামাজিক রীতিনীতি ও লৌকিক জীবনের নানা অনুষঙ্গ, অনেক মিথ, গল্প বাংলা রামায়ণে ইচ্ছাকৃতভাবে ঢুকিয়ে বাংলা রামায়ণ আরও সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেন। সেখানে তিনি কালিকা পুরাণের ঘটনা অনুসরণে ব্রহ্মার পরামর্শে রামের দুর্গাপুজো করার কথা উল্লেখ করেছেন। শক্তিশালী রাবনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বিজয় নিশ্চিত করতে শরৎকালে শ্রীরামচন্দ্র কালিদহ সাগর থেকে ১০১টি নীলপদ্ম সংগ্রহ করে দুর্গাপুজো করে।

পুরানের সাথে সাথে ইতিহাসের পাতাতেও দুর্গাপুজোর উল্লেখ পাওয়া যায়। পরিব্রাজক ও বৌদ্ধ পন্ডিত হিউয়েন সাংকে নিয়েও দুর্গাপুজোর কাহিনী প্রচলিত আছে। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যেও এই পুজোর অস্তিত্ব পাওয়া যায়।

মৈথিলী কবি বিদ্যাপতির ‘দূর্গাভক্তিতরঙ্গিনী’তে দুর্গা বন্দনার কথা পাওয়া যায়। ঘটা করে দুর্গাপূজা চালুর আগে কিছু কিছু উচ্চবর্ণ হিন্দুদের গৃহকোণে অত্যন্ত সাদামাটাভাবে ঘরোয়া পরিবেশে এই পুজো চালু ছিল। আর ঘটা করে দুর্গাপুজোর ইতিহাস, খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। তবে কখন থেকে ঘটা করে এই পুজো চালু হল-তা নিয়ে পরিষ্কার ঐতিহাসিক কোনো প্রমান পাওয়া যায় না। কারো মতে, ১৫০০ খ্রীষ্টাব্দের শেষের দিকে দিনাজপুরের জমিদার প্রথম দুর্গাপুজো করেন। ১৫১০ সালে কুচ বংশের রাজা বিশ্ব সিংহ কুচবিহারে দুর্গাপুজোর আয়োজন করেছিলেন। অনেকে মনে করেন, ১৬০৬ সালে নদীয়ার ভবনানন্দ মজুমদার দুর্গাপূজার প্রবর্তক। ১৬১০ সালে কলকাতার বারিশার রায় চৌধুরী পরিবার প্রথম দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিল বলেও ধারণা করা হয়। ১৬১০ সালে কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার দুর্গার ছেলে মেয়ে সহ সপরিবারে পূজা চালু করেন বলে অনেকের ধারণা।

১৭১১ সালে অসম রাজ্যের রাজধানী রংপুরের শারদীয় পূজার নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন ত্রিপুরা রাজ্যের দূত রামেশ্বর নয়ালঙ্কার। নবাব সিরাজ উদদ্দৌল্লার আক্রমনে কলকাতার একমাত্র চার্চ ধ্বংস হবার পর সেখানে কোনো উৎসব করা অবস্থা ছিল না। পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের জন্য ১৭৫৭ সালে কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়িতে রাজা নবকৃষ্ণ দেব লর্ড ক্লাইভের সন্মানে দূর্গাপূজার মাধ্যমে বিজয় উৎসবের আয়োজন করেছিলেন।

আধুনিক দুর্গাপুজোর প্রাথমিক ধাপ ১৮ শতকে। বাংলাদেশের সাতক্ষীরার কলারোয়ার ১৮ শতকের মঠবাড়িয়ার নবরত্ন মন্দিরে এই পুজো হত বলে লোকমুখে শোনা যায়। পাটনাতে ১৮০৯ সালের দুর্গাপুজোর ওয়াটার কালার ছবির ডকুমেন্ট পাওয়া গেছে। ওড়িষার রামেশ্বরপুরে একই স্থানে ৪০০ শত বছর ধরে সম্রাট আকবরের আমল থেকে দুর্গাপুজো হয়ে আসছে বলে জানা যায়।

বর্তমানে দুর্গাপুজো দুইভাবে হয়ে থাকে, ব্যক্তিভাবে পারিবারিক স্তরে ও সমষ্ঠিগতভাবে পাড়া স্তরে। ব্যক্তিগত পুজোগুলি নিয়মনিষ্ঠা ও শাস্ত্রীয় বিধান পালনে বেশি আগ্রহী হয়। এগুলির আয়োজন মূলত বিত্তশালী বাঙালি পরিবারগুলিতেই। অন্যদিকে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাসিন্দারা একত্রিত হয়ে যৌথ উদ্যোগেও দুর্গোৎসবের আয়োজন করেন। এগুলি বারোয়ারি বা সর্বজনীন পূজা নামে পরিচিত। সমষ্ঠিগতভাবে, বারো ইয়ার বা বারোয়ারী পূজা ১৭৯০ সালে হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়াতে হয়। সেখানে বারো জন বন্ধু মিলে টাকা-পয়সা (চাঁদা) তুলে প্রথম সার্বজনীনভাবে বড় আয়োজনে দূর্গোৎসব পালন করেন- যা বারোইয়ার বা বারো বন্ধুর পূজা নামে ব্যাপক পরিচিতি পায়।

কাশিমবাজারের রাজা হরিনাথ ১৮৩২ সালে বারোইয়ারের এই পূজা কলকাতায় পরিচিত করান। পরে তাদের দেখাদেখি আস্তে আস্তে তা উচ্চবর্ণের হিন্দু বাঙালি জমিদারদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সম্ভবত সেই থেকে বারোয়ারী পূজা শুরু। ১৯১০ সালে সনাতন ধর্ম উৎসাহিনী সভা ভবানীপুরে বলরাম বসু ঘাট লেনে এবং একই জেলায় অন্যান্যরা রামধন মিত্র লেন, সিকদার বাগানে ওই বছরে ঘটা করে প্রথম বারোয়ারী পূজার আয়োজন করে।

বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এই পুজো ঐতিহ্যবাহী বারোয়ারী বা কমিউনিটি পূজা হিসাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। আর স্বাধীনতার পর এই পুজো তো পৃথিবীর অন্যতম প্রধান উৎসবের মর্যাদা পায়।

দেবী দুর্গার বাহন সিংহ। বাংলায় দেবী দুর্গার যে মূর্তিটি সচরাচর দেখা যায় সেটি পরিবারসমন্বিতা বা সপরিবার দুর্গার মূর্তি। এই মূর্তির মধ্যস্থলে দেবী দুর্গা সিংহবাহিনী ও মহিষাসুরমর্দিনী; তাঁর ডানপাশে লক্ষ্মী ও গণেশ; বামপাশে সরস্বতী ও কার্তিক। এছাড়াও বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর সংলগ্ন অঞ্চলে দেবী দুর্গার এক বিশেষ মূর্তি দেখা যায়। সেখানে দেবীর ডানপাশে উপরে গণেশ ও নিচে লক্ষ্মী, বামে উপরে কার্তিক ও নিচে সরস্বতী এবং কাঠামোর উপরে নন্দী-ভৃঙ্গীসহ বৃষ বাহনে শিব ও দুইপাশে দেবীর দুই সখী জয়া ও বিজয়া অবস্থান করেন। কলকাতার কোনও কোনও বাড়িতে দুর্গোৎসবে লক্ষ্মী ও গণেশকে সরস্বতী ও কার্তিকের সঙ্গে স্থান বিনিময় করতেও দেখা যায়। আবার কোথাও কোথাও দুর্গাকে শিবের কোলে বসে থাকতেও দেখা যায়। এগুলি ছাড়াও বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে দেবী দুর্গার বিভিন্ন রকমের স্বতন্ত্র মূর্তিও চোখে পড়ে।

দুর্গাপূজার অন্যতম বৈশিষ্ট্য কুমারী পূজা। দেবী পুরাণে কুমারী পূজার সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। শাস্ত্র অনুসারে সাধারণত ১ বছর থেকে ১৬ বছরের সুলক্ষণা কুমারীকে পূজা করার উল্লেখ রয়েছে। ১৯০১ স্বামী বিবেকানন্দ সর্বপ্রথম কলকাতার বেলুড় মঠে ৯জন কুমারী পূজার মাধ্যমে এর পুনঃপ্রচলন করেন। তবে এর আগেও কোথাও কোথাও কুমারী পূজা হত। ১৯০১ সালের পর প্রতিবছর দুর্গাপূজার অষ্টমী তিথিতে এই পূজা চলে আসছে।

সরকারী বা জাতীয়ভাবে এই উৎসবকে দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব হিসাবে অভিহিত করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় এটাকে শরৎকালের বার্ষিক মহাউৎসব হিসাবে ধরা হয় বলে একে শারদীয় উৎসবও বলা হয়। রামায়ন অনুসারে, অকালে বা অসময়ে দেবীর আগমন বা জাগরণ বলে শরৎকালের দুর্গোৎসবকে অকালবোধনও বলা হয়।

পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও আসাম, বিহার, দিল্লী, উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গোয়া, গুজরাট, পাঞ্জাব, কাশ্মীর, অন্ধ্র প্রদেশ, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, কেরালায় ঘটা করে এই উৎসব পালন করা হয়। নেপালে ও ভুটানেও স্থানীয় রীতি-নীতি অনুসারে প্রধান উৎসব হিসাবে পালন করা হয়। বিদেশে যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, জার্মানী, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর, মরিশাস, ফিজি, কুয়েত, মালয়েশিয়া সহ বিশ্বের বহু দেশে বাঙালীদের নানা সংগঠন এই উৎসব পালন করে থাকে।

ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিক, ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রাচীনকাল থেকেই দেবী দুর্গার আরাধনা হয়ে আসছে। যেখানেই উপাসনা হোক না কেন তা অশুভ শক্তির বিনাশের আকুতি নিয়েই হয়। হয়তো স্থানভেদে দুর্গা নামটিও পরিবর্তিত হয়েছে। আজ প্রবাহমান কালের ধারায় এই পুজোর আচার বদলেছে। ধর্মীয় অনেক আঙ্গিকও বদলেছে। ক্রমে ক্রমে এই পুজো তাই আজ সর্বজনীন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.