কাজের সূত্রে আমাকে পুণে’তে থাকতে হয়। বাঙালি মাত্রেই যে ঘরকুনো বলে অনেকে, আমি ঠিক সেরকম নই। ঘুরতে ভালোবাসি ভীষণ। উইকেন্ডে আমার দু’চাকার বান্ধবীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি যেখানে ইচ্ছে সেখানে। আর এই ইচ্ছে’কে আটকে রাখে কার সাধ্যি।
কোভিড সিচুয়েশন আমাদের অনেক কিছুই বদলে দিয়েছে গত বছর থেকে। ২০২০-তে আমিও পুণে’তে আটকে গিয়েছিলাম লকডাউনের কারণে। সারা দেশেই তখন লকডাউন। বাড়ি ফিরতে পারিনি। ফ্লাইটে যাওয়ার কথা ভাবতে পারিনি সেই সময়। এদিকে বাবা, মা-এর জন্য দুঃশ্চিন্তা। তারাও আমাকে নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। আর পুজো চলে এসেছিল সামনেই। কলকাতার পুজো মানেই এক অন্য আনন্দ। পুজোতে কে বাইরে থাকতে চায়। আমারও একি অস্থির অবস্থা। কবে বাড়ি ফিরবো।
এরপর লকডাউন একটু শিথিল হতেই ভাবলাম, নাহ আর ঘর ছেড়ে এতদিন থাকা সম্ভব হচ্ছে না। তাই ঠিক করলাম এবার ব্যাগপ্যাক করতে হবে। কিন্তু সব থেকে বড়ো মুশকিল হলো যাওয়া নিয়ে। ফ্লাইটে চাপা এখন অনেক ঝক্কির। তার উপর ট্রেনও সেরকম চলছে না। তাই ঠিক করলাম আমার প্রিয় বাহনটি’কে নিয়েই বেরিয়ে পরা যাক। এখানে আবার আরও একটা কঠিন সমস্যা। ফোন হাতে নিয়ে মা’কে একটা ফোন করলাম। বললাম, ‘মা আমি বাইকে করে কলকাতা ফিরছি’। মা শুনেই তো চিৎকার করে উঠল। না একদম নয়, অবশ্য তাঁদের কথাটাও ঠিক। পুণে থেকে কলকাতা ফেরাটা বেশ চ্যালেঞ্জ-এর ব্যাপার। তবু বাবা-মা’কে ভালো করে বুঝিয়ে মানিয়ে নিলাম। যে আমি কেয়ারফুলি রাইড করব।
সেইসময় একটা মেইন কাজ ছিল আমার কাছে, যে মেডিকেল সার্টিফিকেট জোগাড় করা। একটা স্টেট থেকে আর একটা স্টেটে যাব, পারমিশন লাগবে, আমি ফিট আছি কিনা এবং আমার কোভিড সিম্পটম আছে কিনা। তখন আরটিপিসিআর ছিল না। তারপর বাইক সার্ভিস করিয়ে সেপ্টেম্বরের সেকেন্ড উইকে বেরিয়ে গেলাম পুণে থেকে।
বাইকার’দের কাছে বাইক ছাড়া থাকাটা বেশ মুশকিলের ব্যাপার। আর কতদিনই বা ঘরে বসে থাকা যায়। তাই যা হবে দেখা যাবে বলে বেড়িয়েই পড়লাম। শুরু হলো আমার ২০০০ কিলোমিটার ডিসট্যান্স-এর সফরনামা।
পুণে থেকে সেদিন বেরিয়েছিলাম ভোর ৬টায়। সূর্য তখনও ওঠেনি। কিছুদূর যাওয়ার পর যখন সূর্য দিগন্তের আড়াল থেকে আড়মোড়া ভেঙে উঠছে, আমার সফরনামায় যেন নতুন একটা মাত্রা যোগ হল। এই সময়টা বাইক চালাতে কি যে ভালো লেগেছিল। পুণে যখন ছেড়ে আসছিলাম, এই পাহাড় দিয়ে ঘেরা শহরটার জন্য মন কেমন করছিল। কেমন মায়া পড়ে গেছে যেন। অথচ আর একদিকে বাবা, মা, দিদি অপেক্ষা করছে, কলকাতার পুজো অপেক্ষা করছে আমার জন্যে। কি করে কলকাতা ছেড়ে থাকা যায়।
বেরনোর আগে আমি আমার রাইডকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করে নিয়েছিলাম। পুণে থেকে প্রথম এসেছিলাম থেকে হায়দ্রাবাদ। সেখানে পৌঁছই বিকেল ৪টেয়। খুব বেশি ট্রাফিকের জন্য রাতটা এখানেই কাটানোর কথা ভাবলাম। একটা হোটেল দেখে রাতটুকু সেখানেই কাটালাম।
তারপর দিন ভোর ৫টায় হায়দ্রাবাদ থেকে ভায়া বিজয়ওয়াড়া হয়ে ভাইজাগের দিকে এগোই। কিন্তু এরমধ্যে একটা বিপত্তি। কালো মেঘের আকাশ দূর থেকে সতর্ক করে দিচ্ছিল আমায়। এবার কোথাও একটা শেল্টার খুঁজতে হবে, আর নাহলে এভাবেই চালিয়ে যেতে হবে বৃষ্টির মধ্যে। ভাবতে না ভাবতেই বৃষ্টি হুড়মুড়িয়ে চলে এলো। একটা ছোট চালার দোকানের সামনে বাইক রেখে কোনওমতে দাঁড়িয়ে পড়লাম সেখানে। তুমুল বৃষ্টির সঙ্গে মেঘ ডাকা। উফ সে কথা মনে পড়লে এক অদ্ভুত ফিলিংস হয় এখনও। বেশ কিছুক্ষণ বৃষ্টি পরার পর আবার চলতে শুরু করলাম বৃষ্টির মধ্যেই। বিজয়ওয়াড়াতে পৌঁছনোর সময়ও সেই বৃষ্টি আবার ভিজিয়ে গেল আমায়।
কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি কমেও গেল। এখানে রাজামুন্ড্রি নামে একটা জায়গা আছে, গোদাবরী নদীর ওপর অনেক বড়ো ব্রিজ আছে। নদীর পাশে কাশ ফুল দেখতে পেয়ে মন আরো চঞ্চল হয়ে উঠল। উফ! যেন তর সইছে না আর বাড়ি ফেরার। পুজোর গন্ধ পেয়ে আমার বাইকের গতি আরো বেড়ে গেল। অবশ্যই সেটা ১০০-১১০ এর মধ্যে। কারণ মা’কে বলেছি সাবধানে বাইক চালাবো।
বিজয়ওয়ারা থেকে ভাইজাগের রাস্তা বেশ ভালো হওয়ার দরুণ বাইকের স্পিড ১১০-১২০ কিমি রেখেছিলাম। তবে এখানে একটু সাবধানে গাড়ি চালানোর কথা বলব। তার কারণ এখানে গাড়ির ড্রাইভারদের মধ্যে বেশ একটা রেস করার মানসিকতা রয়েছে। তাই একটু সাবধানে গাড়ি চালিয়ে আমিও ভাইজাগের দিকে চললাম।
ভাইজাগ-এ আমি পৌঁছই রাত ৯টায়। হোটেলে চেক-ইন করে পুরো রেস্ট।যেহেতু হোটেলটা একদম সমুদ্রের পাশেই ছিল। রাতে খাওয়ার পর হোটেলের ব্যালকনিতে বসে সমুদ্র দেখার মজাটাই আলাদা। যেহেতু এবার বন্ধু বান্ধবরা কেউ নেই। একদম একা ট্রাভেল করছি। একটু হলেও মিস করছিলাম। তবে এই নির্জনতাও বেশ উপভোগ করেছি। একের পর এক ঢেউ এসে সৈকত ভিজিয়ে যাচ্ছিল। আর আমিও এই সফরনামার এক একটা মুহুর্ত মনের ভেতর লিখে রাখছিলাম।
তারপর দিন অর্থাৎ তৃতীয় দিন সকাল বেলা ভাবলাম। ভাইজাগ-এ যখন প্রথমবার এসেছি। সকালবেলাটা বীচ-এর ধারে কাটানো যাক একটু। সানরাইজ দেখাটাও আমার কাছে একটা থ্রিলিং ব্যাপার ছিল। শুধু যে আমার একার সেটা নয়। সবারই সমুদ্রের সীমান্ত থেকে সূর্যের ওঠা দেখা, এক অন্য ভালো লাগা। ভাবলাম ভোরের আলো ফোটার পর একটু ঘুরে নিয়ে তারপর ভুবনেশ্বরের দিকে রওনা দেবো। এখান থেকে ভুবনেশ্বর ৪৫০ কিলোমিটার মতো হবে।
যেমন ভাবা, তেমন কাজ। ভোরবেলা ভাইজাগের সমুদ্রের ধারে বলতে গেলে আমি একা তখন। কারণ কোভিডের সময় লোকজন নেই সেরকম। এরকম শান্ত সমুদ্রের ধার। মন একেবারে খুশিতে ভরে গেল। আমার আবার একটু নির্জনতাই ভালো লাগে। তাই প্রাণভরে নিশ্বাস নিলাম। মনে মনে প্রার্থণা করলাম, যেন পৃথিবীটা এরকমই শান্ত, অনাবিল থাকে। ভাইজাগ শহরটা খুব সুন্দর। সাজানো গোছানো একটা শহর। এখানে পলিউশন একদম নেই বলতে গেলে। আমি লাঞ্চ করে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম। বেরনোর সময় ভাইজাগের ক্রিকেট স্টেডিয়াম দেখতে পেলাম। বেশ ভালো লাগছিল।
এখানে একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। কারণ এতদিন মহারাষ্ট্রে ছিলাম। আর এখানে অনেক বাঙালিই আসে বেড়াতে নিজের গাড়ি নিয়ে। দেখতে পেলাম ডব্লিউ বি লেখা গাড়ির নাম্বার প্লেট। তখন আমার অদ্ভুত অনুভব হলো, যে বাড়ি ফিরছি আমি। আর অনেক দিন পর বাড়ি ফিরলে পেটের ভেতর কেমন যেন প্রজাপতি ওড়ে। যেন মনে হয়, কবে কবে, আর কতক্ষণ লাগবে। দীর্ঘ লকডাউন পিরিয়ড সেই অবস্থাটা বুঝিয়ে দিয়েছে যেন।পাহাড় ঘেরা শহরের বাইরেটাও এতটাই সুন্দর আর গোছানো, যে আমার ভীষণ ভালো লেগে গেছে। এখানে রাস্তা এত মসৃণ যে বাইক চালাতে এতটুকু অসুবিধে হচ্ছিল না।
ভাইজাগ থেকে বেরিয়ে ৬ লেন-এর রাস্তা, যা অসাধারণ। আমাদের মতো রাইডারদের কাছে তো স্বর্গের মতো। ভাইজাগ থেকে ওড়িশা যাওয়ার ১০০ কিলোমিটার খুব ভালো রাস্তা, পাহাড় দেখতে দেখতে বাইক চালাচ্ছিলাম। যেন মনে হচ্ছিল কোনও এক মুভি সিনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। তবে এরপর ভাইজাগ থেকে ওড়িশা ঢুকে পড়তেই বেশ খারাপ লাগতে শুরু হলো। কারণ এখানে রাস্তায় লোকজন কোনোদিক না দেখেই রাস্তা পারাপার করে। আর প্রচুর ডাইভারসন রয়েছে। তাই সবাইকে বলব এক্ষেত্রে খুব সাবধানে রাইড করতে। রাস্তার অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়।
রাত ৯টায় আমি ভুবনেশ্বর পৌঁছলাম। এমনিতেই রাত হয়ে গিয়েছিল, তার মধ্যে কোভিডের সময়। আমার এক বন্ধু হোটেল বুক করে দিয়েছিল অনলাইনে। কিন্তু আমি যখন সেখানে পৌঁছই। তারা আমাকে হোটেল রুম দিতে মানা করে। পয়সাও রিফান্ড করতে চায় না। এইসব জায়গায় একটু দেখে শুনে তারপর বুকিং করবেন। অনেক চেষ্টার পর শেষে একটা হোটেল পেয়ে শান্তি।
সারাদিনের বাইক ট্রাভেল, একটু তো ক্লান্তি ছিলই, তার উপর হোটেল ওয়ালাদের এরকম ব্যবহার। যাই হোক, খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম। আগামীকাল আমার শেষ দিন, অর্থাৎ কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা। বেশ আনন্দও হচ্ছিল সেই মুহুর্তে। পুজোর মরসুম। কলকাতায় থাকলে পুজো আসছে ব্যাপারটা বেশ ফিল করতে পারতাম। এখানে সেরকম মনে হচ্ছে না যদিও। তবে মনের ভেতর ঢাকের বাদ্যি শুনতে পাচ্ছি যেন।
ভোর ভোর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল অ্যালার্মের আওয়াজে। ভুবনেশ্বর থেকে যতটা তাড়াতাড়ি বেরনো যায় আর কি। এখানকার ওয়েদারে নিজেকে খাপ খাওয়ানোটা মুশকিল। গরমটা রয়েছে বেশ। নিজেকে যথাসম্ভব হাইড্রেটেড রাখার জন্য জল খেলাম। আপনাদেরকেও বলব, এতটা রাইড করলে জল একটু বেশিই খাবেন।
এরপর বেরিয়ে পড়লাম কলকাতার উদ্দেশ্যে। আমার কানে তখন বাজছে, ‘ফির সে উড় চলা… উড়কে ছোড়া হ্যায়… জাহান নিচে… ম্যায় তুমহারে হাওয়ালে আব হু…হাওয়ালে হাওয়া…’ বাড়ির দিকে যত আসছি, ততই যেন মনে হচ্ছে আর কতক্ষণ। যেন সময় ফুড়োচ্ছে না। এক এক করে টোল প্লাজা পেরোতে পেরোতে নিজেকে পাখির মতোই মনে হচ্ছিল। আকাশের মেঘ গুলো আমার সঙ্গে উড়ছিল। আকাশে মেঘ দেখে মনে হচ্ছিল আবার অঝোরে ঝরবে। তবে সেসব পাত্তা না দিয়ে আমি রাইডিং-এ মন দিলাম। আর পাখিদের ওড়া দেখে মনে হচ্ছিল, ওরাও যেন আমার মতো ঘরে ফিরছে। আর মনে হচ্ছিল কতদিন মায়ের হাতের রান্না খাইনি। হাইওয়ের ধারে দোকান গুলো দেখে আর আমার দাঁড়ানোর কথা মনেই হচ্ছিল না। যেন এবার বাড়ি ফিরেই মায়ের হাতের আলু পোস্ত, ডাল ভাত খেয়ে তবেই শান্তি হবে আমার।
এইসব ভাবতে ভাবতেই আবার ঝুম বৃষ্টি। এই বাড়ি ফেরার পথে বৃষ্টি কার ভালো লাগে। সে যাই হোক। খড়গপুর পৌঁছে গেছি ততক্ষণে। তাই একটা চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে চায়ের সঙ্গে হালকা খাবার খেয়ে নিজেকে চার্জড আপ করে নিলাম। তারপর আবার বাইকে স্টার্ট।
সবশেষে ৭ ঘন্টার জার্নির পর যখন বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বাইকের হর্ণ দিলাম। মা বেড়িয়ে এলো। বাবা তার পেছনে। চোখে মুখে আনন্দ। যেন ছেলে দিগবিজয়ী হয়ে ফিরেছে। অবশ্য এখানে একটা মজার কথা বলি, বাবা পুণে থেকে কলকাতা ফেরার ঘটনাটা দু সপ্তাহ ধরে বলে বেরিয়েছে সকল আত্মীয়কে। এখনও সেই দিনটার কথা মনে পড়লে বেশ থ্রিলিং মনে হয়। একা একা পুণে থেকে কলকাতা ফেরা চারটি খানি কথা নয়। তবে বাড়ি আর কলকাতার পুজোর জন্যে এটুকু করাই যায়। সবশেষে বলব, সাবধানে রাইড করবেন সকলে, সুস্থ থাকবেন।
*বাকিটা দেখে নিন ভিডিও-তে
** গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- ORS রাখবেন সবসময়, যতটা পারবেন বাইরের খাবার অ্যাভয়েড করবেন, প্রোটিন বার/ এনার্জি ড্রিংক রাখবেন নিজের কাছে সবসময়।
** সুরক্ষার জন্য- বাইক সার্ভিস করে নেবেন রাইডের আগে, ব্রেক প্যাড, ব্রেক অয়েল, ইঞ্জিন অয়েল চেক করে নেবেন। এয়ার ফিল্টার ক্লিয়ার রাখবেন। টায়ার ইনফ্ল্যাটর রাখবেন এমারজেন্সির জন্যে। আর অবশ্যই চেইন ক্লিনার এবং লুব্রিকেন্ট রাখবেন সঙ্গে।