সেই মেয়ে || সুমিতা চক্রবর্তী

মাঝে মাঝেই মরে যেতে ইচ্ছা করে বাসন্তীর। এই যেমন এখন ইচ্ছা করছে এই পুকুরে ডুবে মরতে। মস্ত বড়ো এই পুকুরটা ওর খুব প্রিয়। কাজের ফাঁকে যখন তখন এসে দাঁড়ায় পুকুর ঘাটে। এটুকুই স্বস্তি। দুপুরে যখন সারা পাড়া নিঝুম হয়ে যায়, ও এখানে বসে দুদণ্ড জিরিয়ে নেয়। ঘাটের সিঁড়িতে বসে জলে পা ডুবিয়ে দেয়। হু হু করে চোখ থেকে জল পড়ে। মনের মধ্যে জমে থাকা দুঃখগুলো উজাড় করে দেয়। পাড়ে ঝুঁকে থাকা ঝুপসি গাছগুলো চুপ করে শোনে ওর কথা। মাঝে মধ্যে ডালপালা হেলিয়ে দুলিয়ে কতো সমবেদনা জানায়। তাতেই খানিকটা শান্ত হয় বাসন্তী। ছোটো থেকে যা চেয়েছে, কিছুই পায়নি। ও যে মেয়ে ! মেয়েদের বেশি কিছু চাইতে নেই। আরো কত কিছু যে মেয়েদের করতে নেই ! ওদের গাঁয়ে মেয়েদের বেশি পড়াশোনা করতে নেই, খেলাধূলা করতে নেই, জোরে হাসতে নেই, জোরে হাঁটতে নেই, সবার আগে খেতে নেই, বেশি বয়স পর্যন্ত বাপের ঘরে থাকতে নেই । এসবই মায়ের কাছে শুনতে শুনতে ছোট্ট বাসন্তী কিশোরী হলো। তারপর শুরু হয়ে গেলো ওর বিয়ের তোড়জোড়। ক্লাস সিক্সে উঠে তাই স্কুল ছাড়তে হলো। পাত্র ঠিক হবার পর খেলাধূলাও গেলো বন্ধ হয়ে। শুনেছিল পাত্র নাকি পনেরো বছরের বড়ো ওর থেকে। পাত্রের অবস্থা ভালো। শহরে বড়ো বাড়ি, পুকুর, বাগান। সুতরাং বাসন্তী সেখানে রাজরানি হয়ে থাকবে। কিন্তু মায়ের এই কথায় মন মানছিলোনা বাসন্তীর। এতদিনের ঘর ছেড়ে, মা, বাবা, দাদাকে ছেড়ে অজানা জায়গায়, অজানা মানুষের সঙ্গে । বাসন্তী কেঁদে আকুল হয়েছিলো। মা বলেছিলো “ওটাই মেয়েদের আসল ঘর। তোর বের জন্য তোর বাপ অতোখানি জমি বেচে দিলো।” খুব অপরাধী মনে হয়েছিল নিজেকে। সত্যিই ওর জন্য কত খরচা হচ্ছে। ও কিইবা দিতে পেরেছে ওদের। শ্বশুরবাড়িতে এসেও মনে হয়, সে ওদের কিছুই দিতে পারেনি। আসলে ওর কাছ থেকে কেউতো কিছু চায়না।ও যে নিতান্ত সামান্য মেয়েমানুষ ! উদয়াস্ত ঘর গেরস্থালির কাজ ছাড়া আর কি জানে। একেতো বাপের ঘরের পাওনাগণ্ডায় মন ভরেনি এবাড়ির লোকের। তার উপর পাড়া গাঁয়ের মেয়ে, দেখতে ভালোনা। লজ্জায় মরে থাকতো বাসন্তী। পাড়া পড়শি মন্তব্য করেছিলো “কালো কুলো এঁদো গাঁয়ের বউ এনেছে দুলাল।” এরা শুধু একটা জিনিস চেয়েছিল ওর কাছে – একটা ছেলে। তাও দিতে পারেনি বাসন্তী। বিয়ের দুবছর পর হলো একটা মেয়ে। সবাই হতাশ হলো। বেশি হতাশ হলো ওর স্বামী। অবশ্য বিয়ের পর থেকে স্বামীর মুখে বিরক্তি ছাড়া আর কিছু দেখেনি। কথাও বলতোনা ভালো করে। শুধু শাশুড়ি যখন ওর ঘরকন্নার কাজে ভুল ধরে নালিশ করতো, তখন সবার সামনে ওকে যাতা বলতো। মুখ বুজে থাকতো বাসন্তী। ও যে বাড়ির বউ। শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ এরাও অকারণে হেনস্থা করে। শাশুড়ির বান্ধবী এক মাসিমা আসে এবাড়িতে। সেও একদিন বাসন্তীকে কাঁদতে দেখে বলেছিলো “কি আর কোরবে বাছা, একেতো হা ঘরের মেয়ে। তার উপর গায়ের রঙ কালো। কি দিয়ে বাঁধবে তোমার পুরুষটাকে !” এখন ওর মেয়ে তিন্নিকেও হেলাফেলা করছে ওরা। বাসন্তী এটা কিছুতেই মেনে নেবেনা। বরং তিন্নিকে নিয়েই । নানা খুব কষ্ট হবে। ঐ একরত্তি জলে খাবি খাবে। দম বন্ধ হয়ে ছটফট করবে। তার থেকে ও একাই ।

বড়ো ফাঁপরে পড়ে গেছে দুলাল। ছমাস আগে ওর বউ কোথায় বেপাত্তা হয়ে গেছে। পাড়ার অনেকে বলছে বউকে নাকি শেষ দেখা গেছে পুকুরপাড়ে। জলে ডুবে মরেছে ভেবে অনেক খোঁজা হয়েছে। কিন্তু পুকুরের জলে বাসন্তীর দেহ পাওয়া যায়নি। ওদের বাড়ীতে খবর দেওয়া হয়েছিলো। তবে ওরা মেয়ের ব্যাপারে বেশি ঘাটঘাটি করেনি। তাই বাঁচোয়া দুলালের। আসলে ওর একমাত্র শালার বিয়ে ঠিক হয়েছে।শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এখন ঐ নিয়ে ব্যস্ত। এদিকে দুলালের দিন চলেনা আর। একরত্তি একটা মেয়েকে নিয়ে সে একা কিভাবে জীবন কাটাবে? বাড়ির লোক, পাড়ার লোক, এমনকি আত্মীয় স্বজন সবাই দুলালের জন্য দুঃখ করেছে। বলেছে শিগগিরি আরেকটা বিয়ে করতে। এদিকে বাসন্তী নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে একবছরও হয়নি। পুরোহিত অবশ্য বিধান দিয়েছে আবার বিয়ে করা যাবে প্রায়শ্চিত্ত করে। তবু ভয় পাচ্ছে দুলাল। বাসন্তী যাওয়ার পর থেকে কিছু উপদ্রব শুরু হয়েছে। কে যেন ওকে ফলো করে। রাতে কে যেন কেঁদে বেড়ায় বাড়ির চারদিকে। ঘুমালে দুঃস্বপ্ন দেখছে। এদিকে তার ঐ একরত্তি মেয়ে তিন্নিটা কেমন বেয়াড়া হয়ে যাচ্ছে। ঠিক ওর মায়ের মতো একরোখা স্বভাব। কারো কথা শুনতে চায়না। মাঝে মাঝে বায়না করে “আমার মাকে খুঁজে এনে দাও।” তখন এমন অস্থির হয়ে কান্নাকাটি করে যে বাড়ির সবাই মিলে ওকে ঠান্ডা করতে পারেনা। কি কুক্ষণে যে বিয়ে করেছিলো বাসন্তীকে। রূপ নেই, গুণ নেই, একটা ছেলে দিতে পারেনা – আবার বড়ো বড়ো কথা। হ্যাঁ সেদিন না হয় চুলের ঝুটি ধরে মেরেছিল সবার সামনে, তাই বলে ঘর ছেড়ে চলে যাবে। এর আগেকি চড় থাপ্পড় মারেনি দুলাল। কোন স্বামী তার স্ত্রীর অমন বেয়াদপি সহ্য করবে। সকালবেলা কাজের সময় বসে বসে গপ্পের বই পড়া হচ্ছিল। এর আগেও ওকে বারণ করেছিলো বই পড়তে। মেয়েমানুষের অতো পড়া কিসের? বিদ্যাতো ক্লাস সিক্স অবধি। তাতে অতো রবি ঠাকুর, শরৎচন্দ্র পড়া কেন। সেদিন মা এসে নালিশ করতে মাথায় আগুন ধরে গেছিলো দুলালের। রাতে বাসন্তী ওকে বলেছিলো “তুমি সবার সামনে আমার গায়ে হাত দিলে ! আমি আর এখানে থাকবোনা।” দুলাল ভাবতেই পারেনি বাসন্তী সত্যি সত্যিই চলে যাবে। চিন্তা ভাবনায় দিন দিন বিপর্যস্ত হয়ে পরছে দুলাল। ওদের পাড়া থেকে কিছু দূরে একটা শিবমন্দির আছে। শুনেছে সেখানে নাকি এক ভৈরবীর আগমন ঘটেছে। অত্যাশ্চর্য তাঁর ক্ষমতা। যে যা সমস্যা নিয়ে যাচ্ছে, সমাধান করে দিচ্ছেন। কাতারে কাতারে লোক রোজ ছুটছে সেখানে। দুলালও যাবে সেখানে। যদি কিছু সুরাহা হয়।

শিবমন্দিরের চাতাল লোকে লোকারণ্য। সামনে এগোনো দায়। অনেক কষ্টে ভীড় ঠেলে মাকে নিয়ে দুলাল উঁকি দিলো ভীড়ের মধ্যে থেকে। চাতালের উপর উপুর হয়ে পড়ে আছে এক মহিলা। গায়ে টকটকে লাল বস্ত্র। মাথায় দীর্ঘ জটা। চাতালে পাগলের মতো মুখ ঘষছে। শরীরটা বেঁকেচুরে যাচ্ছে  খানিক পরে মুখ তুললেন। মুখ থেকে গ্যাজলা বেরোচ্ছে। মাথা, কপাল সিন্দুরে লেপা। মুখে ভষ্ম মাখা। চোখদুটো জবা ফুলের মতো লাল। দুলাল ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলো “কি হয়েছে ওনার?” ভীড়ের মধ্যে থেকে একজন বলল “ভৈরবী মায়ের ভর হয়েছে। এইসময় যাকে যা বলবে, অব্যর্থ ফলে যাবে। দেখছেননা কেমন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে লোকে। মা সাক্ষাত দেবী।” বলে জোড় হাত কপালে ঠেকাল। দুলালের মনে আশা জাগল। ও মায়ের হাত ধরে অনেক কষ্টে সামনে গেলো। ঐ মূহুর্তে মুখ তুলে ভৈরবীর চোখ আটকে গেলো ওদের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল “মহা পাপ করেছিস তোরা। তোদের নিস্তার নেই। ঘরের বউকে একটু ভালোবাসিসনি, একটু সম্মান দিসনি। দূর হ এখান থেকে।” ভয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো ওরা – এযে সব ঠিক বলছে ! দুলালের মা গুটিগুটি পায়ে গিয়ে গলবস্ত্র হয়ে ভৈরবীকে প্রণাম করলে। মিনমিন করলে “মা, অন্যায় হয়েছে। ক্ষমা করে দেন। ঐ বউও খুব বেয়াড়া ছিলো। সে নিজেই কোথায় গিয়ে মরেছে। এখন পেত্নী হয়ে জ্বালাচ্ছে। ছেলেটার আমার বড়ো কষ্ট। পুরুষ মানুষ, কতদিন একা থাকবে? তার উপর ওর একরত্তি জেদি মেয়েকে সামলানো। তাই ঠিক করেছি মা, ছেলের আবার বে দেবো। আপনি আশীর্বাদ করুন – বে যাতে নির্বিঘ্নে হয়। বাড়ির ত্রিসীমানায় যেন ঐ পেত্নী না ঘেষতে পারে, তার একটা ব্যবস্থা করে দিন।” বলে পা জড়িয়ে ধরল ভৈরবীর। ভৈরবী উঠে বসে বললেন “সে বউ কি সত্যিই মরেছে?” দুলালের বুকটা কেঁপে উঠল। তবু জোর দিয়ে বলল “আমরা তাকে অনেক খুঁজেছি। বেঁচে থাকলে ।” ভৈরবী বললেন “বেশ, তবে ছেলের বে‘ র আয়োজন কর। আমি নিজে যাবো। দেখি কোন পেত্নী কি করতে পারে !”

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। দুলাল সাজগোজ করছে  রাতের লগ্নে বিয়ে। শ্বশুরবাড়ি বেশি দূরে নয়। এবার শহরের মেয়ে আনছে। পয়সাওয়ালা ঘর। এবার দুলাল আটঘাট বেঁধেই এগোচ্ছে। বাড়ীতে আত্মীয় স্বজনের ভীড়। সবাই বরযাত্রী যাবে। দুলাল বর বেশে এসে প্রণাম করলো মাকে। মায়ের মুখ থমথমে। ভৈরবী মা এলেন না এখনো। এদিকে তিন্নি কারুর সাথে কথা বলছেনা। নামছেও না দোতলা থেকে। ও নাকি বরযাত্রী যাবেনা। এমন সময় “জয় চামুণ্ডা” বলে হুঙ্কার দিয়ে ভৈরবী মা এসে দাঁড়ালেন। সারা গায়ে বিভূতি, হাতে মস্ত ত্রিশূল। সবাই ভৈরবীকে অভ্যর্থনা জানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ভৈরবী কাউকে কিছু না বলে গটগট করে ঢুকে গেলেন দুলালের ঘরে। দেওয়ালে টাঙানো বাসন্তীর ফটোতে মালা পরানো হয়েছে। ভৈরবী এক দৃষ্টে চেয়ে রইলেন সেদিকে। ভৈরবীকে দেখতে সবাই ভীড় করলো সেখানে।ভৈরবী এসেছে শুনে তিন্নি নেমে এসেছে তাঁকে দেখতে। বাবার পিছনে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে উঁকি দিচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে ভৈরবী খপ করে ধরে ফেলেছে তাকে। সবাই অবাক হয়ে দেখল ভৈরবী তিন্নিকে জড়িয়ে কাঁদছে। চোখের জলে ওর বিভূতি ধুয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে ঘরে ঢুকে পড়ল একদল পুলিশ। ওরা দুলালকে বলল “স্ত্রী বেঁচে থাকতে আবার বিয়ে করার অপরাধে আপনাকে এরেস্ট করছি। দুলাল রাগে চেঁচিয়ে উঠল “এসবের মানে কি?” এবার ভৈরবী এক টানে খুলে ফেলেছে তাঁর মাথার মস্ত জটা। কাপড়ের খুটে মুখটা ভালো করে মুছে নিয়ে বলল “দেখুনতো আপনারা আমায় চেনেন কিনা !” সবাই হতবাক হয়ে গেলো – এযে তাদের বাড়ির বউ ! বাসন্তী চোখের জল মুছে বলল “জলে ডুবে মরতে গেছিলাম। পারিনি। সাঁতার জানতাম যে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে একদল তান্ত্রিক সাধুদের সঙ্গে ক’মাস তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়ালাম। মন শান্ত হলনা। বারবার তিন্নিকে মনে পড়ত। আমি যে মা ! তাই এবাড়িতে ওকে ছায়ার মতো অনুসরণ করতাম লুকিয়ে। সাহিত্য পড়তে ভালবাসতাম। রবীন্দ্রনাথের গল্প “স্ত্রীর পত্র” পড়েছি। কোথায় যেন মৃণালের সাথে নিজের জীবনের মিল খুঁজে পেয়েছিলাম। দিন কাল আজও খুব বেশি বদলায়নি। তবু আমি মৃণাল নই, বাসন্তী। এযুগের মেয়ে। তাই অভিমান করে সরে না গিয়ে ফিরে এলাম। এবার সব অপমানের শোধ নেবো কড়ায় গণ্ডায়। “পুলিশ অফিসার, হাঁ করে দেখছেন কি? নিয়ে যান আমার স্বামীকে।” বলল বাসন্তী। তিন্নি এতক্ষণ চুপ করে সব শুনছিল। এখন বাসন্তীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলল “মা, তুমি ফিরে এসেছো? আমাকে ছেড়ে আর কোথাও যেওনা।“

Leave a Reply

Your email address will not be published.