ইদানীং দুপুরে রোজ একটা মেঘ পশ্চিমের দিক থেকে এসে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তেতে থাকা চারপাশটা একটা মলিন রঙে ঠান্ডা হয়ে ওঠে। তারপর হারুর কথা অনুযায়ী দাঁড়িয়ে থাকা স্থির গরুর মতো ছড়ছড় করে মুতে দেয় ছোট ছোট ভেড়ার পালের মতো মেঘেরা।
শুনশান শহরে একা একাই ঝরে যায় বৃষ্টি। অলস বৃষ্টির সাথে হালকা রোদ মিশে থাকে কখনও, কখনও ছাই রঙের মেঘে কালো হয়ে ওঠা চারদিক শুধু ভয় দেখিয়েই চলে যায়, রেখে যায় কিছু ঠান্ডা এলোমেলো হাওয়া আর সবশেষে ভ্যাপসা গুমোট অস্বস্তি থেকে যায় অবশিষ্ট দিনের গায়ে।
হারু ঠিক এইভাবে ভাবে না। সে রিক্সা চালায়। এখন মহামারীর শহরে তার মনে হল শ্মশানে বৃষ্টি নেমেছে।‘শ্মশানে নাচিছে শ্যামা’গানটা বেসুরো টানে এককলি গাইতে গিয়ে গাইল শ্মশানে কাঁদিছে শ্যামা। নগেন কাঁসারীদের ভাপ ওঠা সিমেন্ট বাঁধানো রকে শুয়েছিল সে। কিছুদিন আগেও রিক্সাটাকে চোখের নাগালে রেখে সামনে কালি মন্দিরের শ্বেতপাথরের চাতালে দিব্যি ঘুম দেওয়া যেত। সে এখন আর হয় না। গোটা পাঁচেক কুকুর আর বেনে বাড়ির পাগলিটা খাওয়াদাওয়া সেড়ে ওখানে এসে ওঠে। কুকুরগুলোর সঙ্গে শোওয়া যায়, কিন্তু পাগলিটা? সে লোকজন মানে না, চিলচিৎকার করে গুষ্টির সবাইকে কাঁচা কাঁচা খিস্তি দেয়। ওখানে থাকলে একটাও ভাড়া আসবে না। তাই স্ট্যান্ডে রিক্সা লাগিয়ে মেঘ জমার শুরু থেকেই যেহেতু সে শুয়েই ছিল নগেন কাঁসারীর রকে। ঠান্ডা হাওয়াটা তাকে প্রায় ঘুম পারিয়ে দিয়েছিল। ঝমঝম করে বৃষ্টিটা নামতেই সে আচমকা লাফ মেরে উঠে বসল আর তখনই তার মনে হল, শ্মশানে বৃষ্টি নেমেছে।
তাড়াতাড়ি উঠে বসেই সে মাস্কটা মুখে লাগিয়ে নেয়। কারণ যদিও রোগ তার কিছু কম নেই তবু যে-কোনো সময় ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে সে। চারদিক তাকিয়ে ভালো করে দেখে নিয়ে একটা স্বস্তির শ্বাসও টানল সে। কারণ পশ্চিমে সূর্য উঠেছে ! মদনা আসেনি। স্ট্যান্ডে তার রিক্সা নেই। সে একা। যতই শ্মশান শহর হোক দু একটা মুখঢাকা, হাতে মোজা পড়া লোক কিংবা মেয়েমানুষ এখনও রিক্সা খুঁজতে আসে। এলে সেটা হারুর ভোগে লাগবে। তার খুশি হবার কারণ যথেষ্টই। মনটা খুশিতে ভরে ওঠে এই ভেবে যে শ্মশান শহরে সে আপাতত একা। অটো-টোটো কোথাও কিচ্ছু নেই। যতদূর চোখ যায় মোড়ের মাথার চার রাস্তা সব বিলকুল ফাঁকা!তার রিক্সা বিনে পাড়ানি কই?
এই ছেলে, ষ্টেশন যাবে? হারুর মেঘ না চাইতে জল! বৃষ্টিটা সামান্য ধরেছে কী ধরেনি, অমনি হারুর যেন মলোমাস আলো করে শূন্য শ্মশানে দেখা দিল বুড়িটা ! মুখের মাক্স এক কান থেকে খুলে আর এক কানে ঝুলছে। বসে থাকা হারু চটকা ভেঙে ঊঠে দাঁড়ায়, চলেন।
ভাড়া কত নিবি?
হারু মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে বুড়িটার, চেনা মানুষ, পঞ্চাননতলায় থাকে। দু পয়সা বেশী পেলে ভালোই হয়। এই লকডাউনের চক্করে দিনে তিরিশ টাকা তুলতেই তার টেংরি খুলে যাবার দাখিল। চারদিকে তাকায় হারু। শ্মশানপুরী। সে একাই রিক্সা নিয়ে নিধিরামের মতো খাড়া হয়ে রয়েছে। তা এ অবস্থায় দুপয়সা বেশি চাইবার হক তার আছে বইকি। অলবাত আছে। সে ঘাড় শক্ত করে বলে, কুড়ি টাকা দেবেন।
ও বাবা ! টোটোওলা দশ টাকা নেয়, তোমার একেবারে ডবল !
সামান্য হলেও হারু একটু দমে গেল। দুদিন ধরে পকেটে একটা পয়সা নেই। সংসার চলে না, একবেলার খাবার দুবেলা খেতে হয়। এখন যদি খদ্দেরটা হাত ছাড়া হয়? তাহলে? হারু চোখ পিটপিট করে। একবার মুখ ফসকে বলতে যায়, টোটো ফোটো কিচ্ছু পাবেন না ঠাকমা। সব বন্ধ। কিন্তু সাহস হয় না। সিটের ওপর উঠে প্যাডেল করার কায়দায় নিজেকে রেডি করে বলে, উঠুন পনেরো টাকা দেবেন।
দশ টাকায় যাবে?
পাগলা ভাত খাবি না আঁচাবি কোথায়! হারু ইতস্তত মাথা চুলকে নেয়, মাস্কটা ঠিকমতো মুখ লাগাতে লাগাতে মিনমিন করে বলে, উঠুন।
ভাগ্যিস মদনা নেই! থাকলে ছোঁ মেরে নিত তার খদ্দের। ওরা তিন পুরুষ ধরে রিক্সা চালাচ্ছে। এই লাইনের ঘাঘু মাল। মদনার বাবা টিকনা তার বাবা ঘুটিয়া। টিকনাকে ছোটবেলায় হারু দেখেছে। ওদের রক্তে রিক্সা চালান। আগে স্ট্যান্ডে আট-দশটা রিক্সা থাকত। ক’দিন আগেও ছিল তিনজন। বিশেটা মরে যাবার পর এখন সে আর মদনা। বিশে মারা যাবার পর একটু বেড়েছিল রোজগার। তারপরেই লকডাউন। তার মধ্যেও মদনা শালা খদ্দের ভাঁড়িয়ে নিত। লকাডাউনের ফাঁকা রাস্তায় শনির দৃষ্টি দিয়ে বসে থাকত। দূর থেকে পথচলতি লোক দেখলেই ছুটে এসে রিক্সা নিয়ে আগে চলে যেত খদ্দের তুলতে।
রিক্সা চালাতে চালাতে হারু আপন মনে মদনাকে শাপ শাপান্ত করে। চতুর্দিকে এত্ত মরছে, এ শালা মরেও না!
দু-মাস হয়ে গেল লকডাউন। কাগজে নাকি লিখেছে এটাকে বলে মহামারী। এরপর মানুষের না খেতে পেয়ে মরার দিন আসছে। হারু এখনই খেতে পায় না। রেশনের চাল আর মাঝে মাঝে ত্রাণের ওপর বেঁচে থাকা। নেই ঘরে যেন খাই খাই বাড়ে। তাছাড়া হাতে টাকা তো দরকার, বিড়িটা দেশলাইটা রাস্তা ঘাটে চা-টা। হারু ভেবে পায় না এভাবে চলতে থাকলে তার কী করণীয়। এমনিতেই টোটো আসার পর রিক্সার রমরমা আর নেই, তার ওপর মহামারী। মদনের কথা শুনলে আরও ভয় করত তার। বলে কিনা এর পর চীনারা নাকি গঙ্গার জলে কী একটা মেশাবার কথা ভাবছে। সেটা মেশালেই ওই জল এমন বিষাক্ত হবে যে কেউ চান করলেই সে প্রথমে কালো হয়ে যাবে, তারপর শুকিয়ে যাবে, তারপর গা থেকে মাংস খুলে যাবে একটু একটু করে। হারুর ভয়টা একটু বেশিই, সে এমনিতেই কালো আর শুকনো। মদনা বলছিল, তোর তার মানে চান না করলেও মাংস খুলে যাবেই। নিজেকে অসহায় ভাবে সে। তাদের মতো মানুষেরা কবেই মরে গেছে। কেউ কেউ আধমরা। মহামারীই হয়তো তার ধুকপুক করা প্রাণটা একদিন নিয়ে নেবে। বউ-বাচ্চার কী হবে?
মাথার ঠিক থাকে না তার। রিক্সা চালাতে চালাতে তার পথ ভুল হয়ে মাঝে মাঝে। স্টেশনের দিকে যাবার কথা, সে বড় রাস্তায় উঠে হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে দেয় গরিফার দিকে। বুড়িটা চিৎকার করে ওঠে, এই ছেলে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? বললাম না স্টেশন যাব!
হারু সঙ্গে সঙ্গেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে গাড়ি ঘোরায়। ক্ষমা চেয়ে নেয় তার ভুলের জন্য।
অদ্ধেক দিন পেটে ভাত পরে না হারুর। শরীরে বল আনার জন্য দুপুরে বেরিয়ে এক পাত্তর ঝাঁঝের-পানি পেটে চালান করে দিলে আর চিন্তা নেই। সেই পয়সাটুকুও বুঝে নিতে ঝঞ্ঝাট কম নয়। মালতীর সঙ্গে অনেক কামড়াকামড়ি করতে হয় তাকে। আগে দুটো টুসকি দিয়ে ঢলানি মার্কা কথার তোড়ে পয়সা চলে আসত। এখন হাওয়া ঘুরে গেছে লকডাউনের পর। হয় ভাত ঘুম নয় ঝাঁঝের খোয়ারি, কিছু একটা না হলে একা একা স্ট্যান্ডে সময় কাটে না। কাঠের চোখ নিয়ে থুম হয়ে বসে থাকতে থাকতে একসময় ভয় করে। অজানা ভয় । মালতী এসব বুঝতেই চায় না। খোয়ারি হলে সব দুঃখ হরিপালে চলে যায়। মদনা না থাকার কারণেও খানিকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। সে গেছে তো আপদ বালাই চুকেছে। রিক্সার ছইয়ের নীচে বসে সিটের ওপর পা তুলে দিয়ে পাগলির গালাগাল শুনতে শুনতে তার ঢুলুনি আসে চোখে। দোকান-পাট বন্ধ, গাড়ি-ঘোড়ার বালাই নেই, লোকজনের চিহ্ন নেই, থাকলেও তাদের মন্থর পথচলায় হারুর মনে হয় সে এই এলাকার মাতব্বর। রাজার মতো সিটের সিংহাসনে বসে সে শাসন করছে তামাম দুনিয়া। তার নির্দেশেই চলবে তিনচাকার যান। তার কাছে এসে বলতে হবে, হারু মহারাজ? যাবেন? হারুর হুকুম হলে চলবে গাড়ি পক্পক্ শব্দে। তার জন্য মুখমাঙ্গা ইনাম দিতে হবে। নইলে চলো, ফোটো এখান থেকে। হারু কী তোমার কেনা গোলাম নাকি হে! এই তল্লাটে আর কারুর গাড়ি লাগাবার হুকুম নেই।
দুপুরের আচ্ছন্ন তন্দ্রায় পক্পক্ শব্দে হারুর রিক্সা ছোটে নৈহাটি শহরের অলিতে গলিতে, লেনে বাইলেনে। তার ফাঁকা গাড়ির ঝনঝন শব্দে শহরটা যেন কেঁপে কেঁপে ওঠে।
সাইকেলের বেল কানে আসে তার। নিস্তব্ধতায় আওয়াজ দ্বিগুণ হয়ে উঠছে। ধড়মড় করে উঠে বসে লালচোখে হারু দেখে পটলা চা নিয়ে বেড়িয়েছে। পটলার সেলুন বন্ধ। লুকিয়ে দু-একবার খুলতে গেলে পুলিশের ডাণ্ডা খেয়ে এখন আর ভয়ে খোলে না। দুপুরে সকালে বড় বড় ফ্লাক্সে চা নিয়ে সাইকেল করে টহল দেয়। পটলাকে দেখে হারু সোজা হয়ে বসে। কাছে আসতেই তাকে দাঁড় করিয়ে বলে, একটা চা দেনা?
কীসের চা? পটলার গলায় রোয়াব, আগের টাকা শোধ করবি তারপর চা চাইবি।
হারু হাত তুলে আশ্বস্ত করে পটলাকে, ভাড়া হচ্ছে না তো কোথা থেকে দেব? ভাড়া হলেই সব পয়সা মিটিয়ে দেব। দে মাইরি একটা চা দে।
কত বাকি জানিস?
জানি, ত্রিশ টাকা।
আর মদনারটা কে দেবে? সে মালটা তো হাওয়া! তারটা কে দেবে?
সে তুই মদনাকে গিয়ে বল। আমি আমারটা টাকা পেলেই দিয়ে দেব। দে চা দে।
সে আর এ জীবনে হবে না। মদনাকে কাল কলকাতায় চালান করে দেবে। গাড়ি আসবে কাল।
কোথায়?
কেন তুই জানিস না? মদনার করোনা হয়েছে।
ভ্যাট! কে বলেছে তোকে?
পটলা কাগজের কাপে একছিটে চা ঢেলে হারুর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলে, তোমার তো জিগরী দোস্ত ছিল। এখন চেপে যাচ্ছ? পাবলিক জানতে পারলে কী হবে একবার ভেবে দেখেছিস? এসব পাত্তারি গুটিয়ে বাড়ি চলে যা। এখন মদনার সঙ্গে যারা যারা ছিল সব শালাকে ধরবে পুলিশ, চোদ্দ দিনের জন্য আটকে রাখবে।
প্রথমে কথাটা শুনে হারুর বুকের ভেতরটা খুশিতে বুড়বুড় করে উঠেছিল। এই না কোনওদিন আবার স্ট্যান্ডে ফিরে আসে হারামিটা, সেই ভয়টা কেটে গিয়েছিল। কিন্তু খুশিটা যেন বেলুনের মতো ফুস করে হাওয়া ছেড়ে দিল। পটলা তাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করলেও, তার কথায় হারুর কোনও হেলদোল হয় না। তাকে কেন খামোকা পুলিশ নিতে আসবে? সে কী মদনার গলা জড়িয়ে বসে থাকত?
পটলার দেওয়া চা ঠান্ডা হয়ে যায় হারুর স্থির হয়ে ধরে থাকা হাতে। বুকের ভেতর খুশির চাকে কে যেন হুল ফোটায়। গায়ে জ্বালা ধরে হারুর। ঠিক বুঝতে পারে না। চা টা বিস্বাদ লাগে। তবু পটলা এই চায়ের জন্য হিসেব লিখে রাখবে। সে রাখুক। ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চা টা টান মেরে ছুঁড়ে ফেলে দেয় ড্রেনে।
দিগবিদিক জ্ঞান নেই হারুর। তার সওয়ার হীন রিক্সা ঝণঝণ শব্দে ছুটে চলেছে শহরের অলিতে গলিতে। বড় জ্বালা তার বুকে। দুএকজন পথচারী রিক্সা দেখে ডাকে। হারু কোন সাড়া শব্দ না দিয়ে হনহন করে ছুটে চলে। তার পথ কোথায় শেষ সে নিজেই জানে না।
গোয়ালাপাড়ার ঘাটে এসে থামে হারু। গঙ্গার ঘাটের কাছে রিক্সা দাঁড় করিয়ে জলের কাছ বরাবর এগিয়ে যায়। হুহু করে বাতাস বইছে। বুকের ভেতর খুশির চাকে হুল ফোটানোর কষ্টটা সে কাউকে বলতে পারছে না। জলের দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে থাকলে তার চোখ দিয়েও জল পড়ছে অনর্গল। হারু বুঝতে পারে না কেন তার বুক ভেঙে যাচ্ছে জলের ঢেউয়ে।
সন্ধে নামে। হারু জামার খুঁটে চোখ মুছে নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় রিক্সার দিকে। হঠাৎই মনে পড়ে, এই গোয়ালাপাড়ার ঘাটের কাছেই মদনার ঘর না। তার বাড়া ভাতে ছাই দেওয়ার শত্তুর। কথাটা তার মনেই ছিল না। সাড়া শহর ঘুরে মরতে সে কেন এল শত্তুরের ডেরায়। তার হুশ উড়ে গিয়েছিল যেন এতক্ষণ। একটা ঘোরের মাথায় সে পাগলের মতো রিক্সা টেনে ক্লান্ত হয়ে গেছে।
কী মনে করে ছাউনির কাছে গিয়ে নীচু স্বরে ডাকে হারু, মদনা, এই মদনা?
কেরোসিনের কুপি হাতে মদনার বউ দোর খুলে দাওয়া পর্যন্ত এগিয়ে এসে বলে, মদনা দেখা করতে পারবে না,ওর করোনা হয়েছে।খুব জ্বর। আপনি চলে যান। আমাদের কাছে এখন কাউকে আসতে নেই । আমাদেরও যেতে নেই।
হারু অন্ধকারে ভূতের মতো ডানহাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, এই টাকা ক’টা দাওয়ায় রাখলাম, মদনার ভাড়ার টাকা।
হারু টের পায় তার বুকের চাকে ফের সেই খুশির বুড়বুড়ুনি ফুলে ফুলে উঠছে।