অহনা একেবারে ঠিক সময়ে আই-ফাউন্ডেশন’এর ওটি’তে পৌঁছে গিয়েছে। কিন্তু সিঞ্চন এখনও এসে পৌঁছল না! বরাবরের লেট-লতিফ। রেগেমেগে একটা মিসড-কল ফেলে রাখে ওর ফোনে অহনা। এবার সে পোশাক বদলে হাত-টাত ধুয়ে ফেলব। সিঞ্চন ফোন করলেও তুলবেনা।
কিন্তু অহনা চেঞ্জিং-রুমে ঢোকার মুখেই হুড়মুড় করে ওটি’র দরজা ঠেলে ঢুকল সিঞ্চন। ইশারায় বাগদত্তাকে একটা ফ্লাইং-কিস ছুঁড়ে দিয়ে শিস দিতে শুরু করল! কি কান্ড! সে জানে যে এই পেশেন্টকে রেফার করে পাঠিয়েছেন তার কাকা, ডাঃ দেবশঙ্কর ঘোষ। তবু এমন ক্যাসুয়াল অ্যাটিচিউড! সিঞ্চনের কাকু কার্ডিওলজিস্ট, সপরিবারে বহু বছর ধরে প্যারিসে। জ্যাঠা আই-স্পেশ্যালিস্ট ছিলেন। বাবা’ই শুধু ইঞ্জিনিয়ার।
অহনাদের বাড়িতে কেউ ডাক্তার নয়। বাবা জ্যোতিপ্রকাশ মিত্র আইনজ্ঞ। ইচ্ছে ছিল মেয়েও নামকরা ফার্মের লইয়ার হয়। তবে সিঞ্চনের জ্যাঠার সাথে তার সখের থিয়েটারে আলাপ। একজন অন্যজনকে ভীষণ পছন্দ করতেন। থিয়েটার দুজনেরই প্রাণ! তাই গভীর বন্ধুত্ব হতে দেরী হয়নি। ‘মণিজেঠু’র আই-ফাউন্ডেশন’এর চেম্বারে অহনার যাতায়াত ছিল। রুগী দেখতে দেখতে মণিশঙ্কর কি কি বলছেন তাতে অহনার গভীর মনোযোগ। ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছিলেন ডাঃ মণিশঙ্কর ঘোষ। ‘না হয় একবার ওর কথাটাই শুনলি জতু, বসতে দে না এনট্রান্সে। চান্স না পেলে না হয় বিচ্ছিরি কালো জামাকাপড়গুলো পড়িয়ে তর্কাতর্কির পাঠ পড়াস,’ বয়েসে অল্প ছোট, প্রিয়বন্ধু জ্যোতিপ্রকাশকে অনুরোধ করেছিলেন অহনার মণিজেঠু।
অহনা চান্স পেল মেডিকাল কলেজে। সাথে সাথে চান্স পেলো মণিশঙ্করবাবুর ভ্রাতুস্পুত্র সিঞ্চন। তারপরের ব্যাপারটা অবশ্য মণিশঙ্কর, জ্যোতিপ্রকাশ কারও হাতেই ছিলনা।
সিঞ্চনের হুল্লোরে স্বভাবের সাথে পড়াশোনায় সিরিয়াস অহনার মিলমিশ না হলেও, তার জেঠুর চেম্বারে বসে কাজ দেখতে দেখতে অগাধ শ্রদ্ধায় ভরে যেত অহনার মন। এর মধ্যেই এসে হাজির হোত সিঞ্চন। ‘আমার কলেজের দার্জিলিং-ট্রিপটা’র পারমিশন ইস্যু করিয়ে দাও না, বস্। তুমি না বললে বাবা ছাড়বে না যে!’ জেঠুর হাত-টাত ধরে ঝাঁকিয়ে যা-তা কান্ড শুরু করে সে।
‘যা ব্যাটা, বলে দেব ‘খন সোমু’কে,’ তার হাত থেকে নিস্কৃতি পান ডাক্তারবাবু। ভাই সোমশঙ্কর তার কথা ফেলতে পারেনা।
অহনা বেড়াতে যায়না বটে, কিন্তু সিঞ্চন ফিরে এলে পাক্কা এক সপ্তাহ কথা বলেনা। ‘আরে, বললাম তো ওটা বয়েস-ওনলি গ্রুপ ছিল! আচ্ছা, ফাইনালের পর নেক্সট ট্রিপ রানীখেত। যাবি তো?’ বলে সিঞ্চন।
ফাইনাল এম-বি-বি-এস’এর ফলাফল দুজনেরই ভালো হয়। ইনটার্নশিপ শুরু হওয়ার আগে রানীখেত ঘুরতে যায় ওরা ছোট একটা দল। রাতের বনফায়ার যে মনের ভেতরে এত আগুন জ্বালাবে তা কে জানত। মাত্র একটা বিচ্ছিরি তেতো বিয়ার, তাতেই অহনা টালমাটাল। মেয়েদের কটেজ অবধি তাকে পৌঁছে দিতে যায় সিঞ্চন। সুন্দরী সহপাঠিনীর ডাগর চোখের তারায় আকাশের হাজার তারার আলো দেখে, একটা মিষ্টি চুমু না খেয়ে পারেনি। পরদিন কি রাগ মেয়ের। ‘আমি জেঠুমণির কাছে সব বলে দেব, ইউ মেড মি ড্রাংক।’ হুমকি দেয় সে। কিন্তু সময় এলে এ বৃত্তান্তের কথা ফাঁস করেনা।
কখনও সিঞ্চনের বন্ধুরা দল বেঁধে তাদের বাড়িতে আড্ডা মারতে গিয়ে সিঞ্চনের মা’কে বলে, ‘এই আমাদের অহু কি করতে এসেছে? তুমি কেন ব্যস্ত হচ্ছ, মাসীমণি! চা-টা করতে হলে ওকে সাথে করে রান্নাঘরে নিয়ে যাও।’
মুখ ফিরিয়ে চোখ পাকিয়েও হেসে ফেলে অহনা, সিঞ্চনের মা’র সাথে রওনা দেয়। দু-বাড়িতে বিয়ের কথাবার্তা পাকা হতে দেরী হয়না। সবচেয়ে খুশি অহনার মণিজেঠু।
অহনা-সিঞ্চন চক্ষুরোগ-বিশেষজ্ঞ হবে, সে কথা আগেই ঠিক ছিল। স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর দুই আই-স্পেশ্যালিস্ট’কে মণিশঙ্কর নিজের হাতে কাজ শেখাতেন। ক্যাটারাক্ট অপারেশন করতে করতে বলতেন, পেশেন্টকে অপারেশনের আগে মানসিকভাবে তৈরি করা দরকার, জেনে নেওয়া দরকার পেশেন্টের পেশা ও জীবনযাত্রা, জানা চাই ব্যক্তিবিশেষের অক্ষিগোলকের মাপ অনুযায়ী কত রকমের আই-লেন্স ব্যাবহার করা যায়, ইত্যাদি। ওরা দুটিতে বেশ কিছু চোখের অপারেশনে ততদিনে হাত পাকিয়ে ফেললেও, ফলিত পরামর্শ কাজে লাগে বৈকি, বিশেষ করে তা যদি আপনজনের কাছ থেকে পাওয়া যায়।
অথচ, ডাঃ মণিশঙ্করের হার্ট-অ্যাটাক’টা হঠাত ধেয়ে আসবে কে জানত। খবরটা পেয়েই ছুটে গিয়েছিল নিজের বাবা-মা’র সাথে অহনা। রাতে অনন্ত ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গিয়েছেন মণিশঙ্কর। কিছুই করা যায়নি। অহনা-সিঞ্চনের আশীর্বাদ এক বছর পিছিয়ে গেল। কিন্তু মণিশঙ্করের স্বপ্ন আই-ফাউন্ডেশন’এর কাজ তো বন্ধ করে দেওয়া যায়না! সাগ্রহে সেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিল দুই নবীন ডাক্তার।
অহনা সকালে চেম্বারের কাজ সামলায়, সন্ধ্যায় রুগী দেখে সিঞ্চন। আর অপারেশন থাকলে দুজনে মিলেই কাজটি করে। পাড়া-প্রতিবেশী ডাক্তারবাবুকে খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করতেন। উত্তরসূরীদের প্র্যাকটিস জমতে তাই বেগ পেতে হয়নি।
এর মধ্যেই একদিন এসে হাজির হলেন সিঞ্চনের কাকার পরিচিত রিটায়ার্ড ভদ্রলোক, মিস্টার দারুব্রহ্ম বন্দোপাধ্যায়। কোট-টাই পড়ে যেদিন প্রথমবার চোখ দেখাতে এসেছিলেন, উনি চলে যাওয়ার পরই অহনা বলে ফেলল, ‘দেখলে তো! পঁয়ষট্টিতেও মানুষ কেমন ছিমছাম, ওয়েল-মেনটেনড? ধোপদুরস্ত পোশাকআশাক! আর তুমি, সেই কবের আকাচা-জিনস-পড়া-পা টেবিলের নীচে লুকিয়ে, টি-শার্টের ওপর হোয়াইট-এপ্রন পড়ে ডাক্তারবাবু সেজে বসে আছ’।
‘আরে, সাজতে হবে কেন! আমি তো ডাক্তারই! তুমিও তো বেশ সালওয়ার-কামিজে বাচ্চা মেয়েটা লাগছো দেখতে। মনে হচ্ছে একবার সাধলেই হাত ধরে ভিক্টোরিয়াতে আমার সাথে ফুচকা খেতে রওনা দেবে’, সিঞ্চনের এই কথার পরে কি আর বাদানুবাদ টেঁকে! সেদিনের কাজকর্ম সারার পর বেড়াতে যাওয়া তো অবধারিত।
তবে দারুব্রহ্ম বন্দোপাধ্যায়ের অপারেশনের দিন ইচ্ছে করেই অহনা একটু আগে পৌঁছেছে। হবু কাকা-শ্বশুরের মনে প্রভাব ফেলতে হবে তো, প্রশংসা পেলে আরও ভালো লাগবে। রমণ’দা জেঠুমণি’র যুগের ও-টি টেকনিশিয়ান। কিছু বলে দিতে হয়না। সিস্টার সব স্টেরিলাইজড ইন্সট্রুমেন্ট সাজিয়ে দিয়েছেন। পেশেন্ট’কে একেবারে পোশাক বদলিয়ে, অপারেশন-টেবিল’এ শুইয়ে রাখা হয়েছে। দারুব্রহ্ম এরই মধ্যে ‘সুপ্রভাত’ বলতে ভুললেন না। প্রতি-শুভেচ্ছা জানিয়ে তাঁকে বিশ্রাম করতে অনুরোধ করে ওরা। অক্ষিগোলকে রেট্রো-বালবার-ব্লক ইনজেকশনটি দিয়ে চোখকে অসাড় করে কাজ শুরু করে।
রমণ অভ্যাসবশতঃ অপারেশন শুরু করিয়ে দিয়ে সাইড-রুমে চা বানাতে চলে গেছে। সিস্টার সার্জারীতে সাহায্য করছেন। দুজন সার্জেনেরই খুব ভালো হাত। সিস্টোটোম বসিয়ে চোখের তারাকে সঠিক জায়গায় রেখে সামনের স্বচ্ছ আবরণ হালকা করে কেটে আরও ভেতরে লেন্স’এর ক্যাপস্যুলের কাছে পৌঁছিয়ে যায় সিঞ্চন। ছোট্ট সাকশন-পাইপ দিয়ে পুরনো ঝাপসা লেন্সটা বের করে ফেলে অহনা। নতুন লেন্স জায়গা মত প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে সিঞ্চন। ভাঁজ খুলে চমৎকার জিনিসটা আপনিই ঠিক জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল। অহনা এবার কর্নিয়ার ক্ষতটুকু বন্ধ করে দেয়। মাথা তুলে সিঞ্চনের দিকে তাকিয়ে বরাবরের মত মিষ্টি হাসে।
ঠিক তখনই প্রিয় নারীকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করে সিঞ্চনের। হাতের কাজটি পুরোপুরি শেষ হয়নি। তাই আরও কিছুক্ষণ একেবারে চুপচাপ। তারপর প্ল্যান মত কথোপকথন শুরু। হ্যাঁ, দুজনেই এক সময়ে অন-লাইনে ফরাসী ভাষাটা শিখেছিল। সত্যি কথা বলতে কি সিঞ্চনের ছোটকাকু দেবশঙ্করই বলেছিলেন, ‘দুজনেরই একটা বিদেশী ভাষা শিখে রাখা ভালো, জানিস। কখন কোথায় কি কাজে লাগে বলা যায়না।’ ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিয়েছিল অহনা-সিঞ্চন। ভাষা শিখতে মন্দ লাগেনি তাদের। অন্যত্র না হলেও এই অপারেশন-থিয়েটারে নিজস্ব কিছু কথাবার্তা বলতে তাই দিব্যি ওরা ফ্রেঞ্চ ব্যবহার করতে পারে।
‘কোয়া দে নিউফ?’ কি হোল! সিঞ্চনকে একটু আনমনা দেখে অহনা জিজ্ঞেস করে বসে।
‘জুন সে পা,’ সিঞ্চন জানায়, সে জানেনা তার আজ কি হয়েছে।
‘অ্যায় দে মোয়া আ কম্প্রউন্দের?’ তুমি কি আমায় জানতে সাহায্য করবে? … সিঞ্চনের পালটা প্রশ্ন।
বক্বকম্ চলল। আজ আই-ফাউনেশনে পৌঁছতে পৌঁছতে সিঞ্চন দেখেছে আষাঢ়স্য-প্রথম-দিবসে আকাশে মেঘ জমছে। দেখতে দেখতে তার মনে কখন যেন এক কলেজ-পালানো-ঝমঝমে-বৃষ্টিদিনের কথা উঁকি দিয়েছে। সেই দুপুরে রাস্তায় জল জমেছিল। অহনার শাড়ি আধভেজা, সিঞ্চনের প্যান্টও গোটানো। কিন্তু কিছুতেই দুজনের কারও বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিল না। সুতরাং হাতের পাঁচ উপায় কাছাকাছি একটি সিনেমা-হলে টিকিট কেটে ঢুকে পড়া। সিনেমা বেশ কিছুক্ষণ শুরু হলেও গল্পটা বিশেষ বোধগম্য নয়। কিন্তু তাতে খুব একটা কিছু যায় আসেনা। তারই মধ্যে একফাঁকে সিঞ্চনের ঠোঁট নেমে এসেছিল অহনার ঠোঁটে। মনে আছে কি অহনা’র? তা আর মনে নেই! কি লজ্জাই না লাগছিল তার। কিন্তু সিঞ্চনকে মানা করতেও ইচ্ছে করছিল না।
মনের কথা ফরাসী ভাষাতেই বলছিল সিঞ্চন। অপারেশন প্রায় শেষ। স্মৃতিচারণ করতে করতেই প্ল্যান হয়ে গেল, যদি বৃষ্টি হয় ওরা কাজ সেরে চলে সোজা চলে যাবে আউটট্রামঘাট। নদীর ওপর ধেয়ে আসে মেঘ। চারপাশ ঝাপসা হয়ে আসা দৃশ্যটা ভীষণ মায়াবী। তবে বেড়ানোর পর যেতে হবে সাবিরে। অনেকদিন ধরে রেস্তোরাঁ’টায় সিঞ্চনের একটা খাওয়া পাওনা রয়েছে। পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট পরীক্ষায় গোল্ড-মেডেলটা তো অহনাই পেয়েছিল, না কি!
কিন্তু খাওয়াদাওয়ার কথা উঠতেই একটা বিটকেল গন্ধ নাকে এলো যে! অপারেশন-থিয়েটার তো আগের দিন স্টেরিলাইজ করা হয়েছে। সিস্টার, রমণদা, দুজনেই কারণটা জিজ্ঞেস করল অহনা। ‘ওটি স্টেরিলাইজ করবে যখন তখন হাত খুলে জিনিষপত্র খরচা করবে, সে কাজে কিপটেমি কোরনা!’ বলে নিজের গাউনে নাকটা একটু চেপে রাখে সে। রমণ বিভ্রান্ত! এসব ব্যাপারে কোনদিনই তো তার ভুল হয়না! মাথা নাড়তে নাড়তে কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে যায়। এদিকে কথাবার্তা শুনে আবার দারুব্রহ্মবাবু উশখুশ করেন, একটু নড়তে চেষ্টা করেন। ‘না না, ইউ প্লিজ রেস্ট। আমাদের কাজ প্রায় শেষ। একটু পরেই আপনাকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হবে,’ অহনা সাবধানী গলায় বলে।
কিন্তু সিঞ্চনের মুখেচোখে দুষ্টুমি খেলে যাচ্ছে। শুয়ে থাকা পেশেন্টের দিকে ইঙ্গিত করে সে অহনা’কে যে ব্যাপারটা বোঝাল সেটা অহনার আন্দাজ করতে অসুবিধে হোল না।
‘ইল আ পেতে,’ বলেই ফেলল সিঞ্চন।
‘সে পুরকোয়া সা পুই ইসি,’ তাই বেশ দুর্গন্ধ, হাসি চাপতে চাপতে বলে অহনা। এবার চটপট হাত চালায় ওরা। নার্সকে চোখে অ্যান্টিবায়োটিক-ড্রপ দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিতে বলে। বাইরে গিয়ে পোশাকআশাক ছেড়ে চা খায়, আর বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা পাকা করে।
পেশেন্ট ভালোই থাকেন। ঘন্টা তিনেক পরে তার ভাইপো এসে গাড়ি করে তাঁকে বাড়ি নিয়ে চলে যায়।
হপ্তা কেটে গিয়েছে। কলকাতার শীত বড়দিনের সময়েই শুধু জানান দেয়। প্রতিবছর ক্রিস্টমাস থেকে নিউ-ইয়ার অবধি একটি সপ্তাহ, আই-ফাউন্ডেশন’কে একটু সুন্দর করে সাজিয়ে দেওয়া হয়। তবে আউটডোর বন্ধ থাকেনা, পেশেন্টরা আসেন। দারুব্রহ্মবাবুও এসেছিলেন। ব্যান্ডেজ খুলে পর্দাটানা ছায়া-ছায়া ঘরে চোখ মেলার পর তার মুখের হাসিখানা দেখার মতন। অহনা খুশি মনে পেশেন্টের হাত ধরে ‘কনগ্র্যাচুলেশনস’ বলে। এমনটিই তো বলতেন মণিজেঠু! অহনার কান্ড দেখে সিঞ্চনও খুশি হয়।
বড়দিনের দিন ছোট একটি ক্রিস্টমাস-ট্রী এক কোণে বসানো হয়েছে। রঙবেরঙের লাইটে জায়গাটা দারুণ ঝলমলে। সেদিন শুধু গুটিকয়েক রুগীর অ্যাপয়েন্টমেন্ট। তারা চোখ দেখিয়ে যাওয়ার সময় প্রত্যেকেই ক্লিনিকের সাজসজ্জার প্রশংসা করলেন। দুই ডাক্তার আজ লাল ক্রিস্টমাস-টুপি পড়ে কাজ করছে। এর মধ্যেই কুরিয়ারটা এলো। এতবড় বাক্সটা কিসের! কই, সিঞ্চনের স্পোর্টস-শু জোড়া আগের সপ্তাহে বাড়িতে ডেলিভারী দিয়ে যাওয়ার পর আর কিছু অর্ডার তো দেয়নি সে!
‘আমি তো অন-লাইনে ড্রেস কিনিই না, তুমি জানোই’ বলে ওঠে অহনা।
যাই হোক, ভেতরের জিনিসটি বের হওয়ার পর সব্বাই অবাক। বিরাট চকলেট-কেক’টা কে পাঠাল! বাক্স থেকে একখানা চিরকুট উদ্ধার হোল। সবার কৌতূহল নিবারণ করল সিঞ্চন। কেক পাঠিয়েছেন দারুব্রহ্মবাবু।
‘দারুণ ব্যাপার! বলে ফেলল সিস্টার!’
‘কি ভালো পেশেন্ট, বলুন দিদি!’ আহ্লাদে গদগদ রমণ।
এসব কথার মাঝখানে সিঞ্চন একফাঁকে অহনাকে ভেতরের চেম্বারে ডাকে। দারুব্রহ্মবাবুর চিঠিখানা না দেখালেই নয়। হাসপাতালের ব্যবস্থাপনায় তিনি যারপরনাই আনন্দিত। অপারেশন ভালো হয়েছে বলে তাঁর সুখের অন্ত নেই। তবে তাঁর সবচেয়ে ভালো লেগেছে অপারেশন চলাকালীন প্রেমের কথামালা শুনতে। মনের ভেতরের সব ভয় উধাও হয়ে গিয়েছিল! ‘সেস্ট ত্রে রমান্টিক!’ প্রেমের গল্প শুনতে কার না ভাললাগে।
বিশ্বে সবকিছুর থেকে প্রেম সবচেয়ে বেশী শক্তিশালী… ল’আমোর এস্ট প্লাস ফোরট কে তুৎ। দারুব্রহ্ম নিজেও প্রেমে পড়েননি কি? পড়েছিলেন বৈকি। আলায়েন্স ফ্রাঁসে’তে অত বছর তিনি ফরাসী ভাষা পড়িয়েছেন। তখনই একবার ভিজিটিং-ফ্যাকাল্টি হিসেবে প্যারিস যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেখানেই প্রবাসী বাঙালীদের ঘরোয়া পার্টিগুলোয় সিঞ্চনের কাকার সাথে তার আলাপ। স্বর্ণকেশী এক সহকর্মিণীর প্রেমে দারুব্রহ্ম সেসময়ে হাবুডুবু খেয়েছিলেন বেশ কয়েক মাস। কিন্তু বাদ সাধল দারুব্রহ্মের মোটা ফ্রেমের হাই-পাওয়ায়ের চশমা। বস্তুটি মহিলার বড় অপছন্দের জিনিস ছিল। ফরাসিনীর মন পাওয়া গেলনা। দারুব্রহ্মের দেশে ফেরার সময়ও ঘনিয়ে এলো। ভগ্ন-হৃদয় প্রেমিক ফিরে এসে আর বিয়ে-থা করলেন না। চোখে ছানি হওয়ার পর উল্লসিত হয়েছিলেন যে এতদিনের শত্তুর চশমা’টাকে বিদেয় করতে পারবেন। এখন এই টাকমাথা নিয়ে আর সেই মনোমোহিনীকে খুঁজে ফেরার অর্থ হয়না তা তিনি জানেন। তবে ‘ত্রেস হিউ রু দে ভু ভোয় ভোয়ের অ্যামরিউ’… অহনা-সিঞ্চনকে ভালোবাসায় লুটোপুটি খেতে দেখে তাঁর মন ভরে গিয়েছে। বিশেষ করে বনফায়ারের পাশে চুম্বন, প্রায় ফরাসী কাহিনীর মত সুন্দর। আর বৃষ্টির দিনের ‘রঁদেভু’! অসাধারণ রোম্যান্টিক!
তবে চিঠিতে সিরাজে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটায় তাদের একটু সাবধান করতে চেয়েছেন দারুব্রহ্ম। চোখের ব্যান্ডেজ খোলার পর দেখতে পান-কি না পান, চলাফেরা সহজ থাকবে কিনা, কে বলতে পারে। তাই অপারেশনের আগের দিন গাড়ি-ড্রাইভার নিয়ে গুটিগুটি দারুব্রহ্ম নিজেও সেখানেই গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। শখ মিটিয়ে প্লেট-দুয়েক রেজালা আর বিরিয়ানী সাঁটিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। হয়ত সেই কারণেই আই-ফাউন্ডেশনের অপারেশন-থিয়েটারে তাঁর পায়ু-নির্গত বায়ু ডাক্তারদের জন্য কিঞ্চিৎ অসুবিধার সৃষ্টি করছিল। সে জন্য তিনি সত্যিই লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। আসলে অপারেশনের শেষদিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন একটু। সুখস্বপ্নে শায়িত অবস্থায় সর্ব-ইন্দ্রীয় দমন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন বোধহয়।
কেলেঙ্কারিটার কথা মুখে বলতে তাঁর একটু লজ্জা করছিল, তাই বড়দিনে কেক’টি উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন। ‘কে দিউ তে বেনিস’, ঈশ্বরের আশীর্বাদ তাদের দুটিকে ঘিরে থাকুক- এই লিখে চিঠি সমাপ্ত করেছেন শ্রী দারুব্রহ্ম বন্দ্যোপাধ্যায়।
পড়া শেষ করে খানিকক্ষণ হাঁ করে বসে রইল অহনা-সিঞ্চন। তারপর হো-হো করে হেসে উঠল দুজনে। ‘কি কান্ড! এবার থেকে দেখছি পেশেন্টকে পার্সোনাল-হিস্টরি জিজ্ঞেস করার সময় তিনি কটা ভাষা জানেন সেও জিজ্ঞেস করে নিতে হবে! ভদ্রলোক ফ্রেঞ্চ জানেন কি করে বুঝব!’, সিঞ্চন হাসতে হাসতে বলে।
‘তাতে কি হয়েছে। আমরা তো নিজেদের সুন্দর মুহুর্তগুলোর কথাই আলোচনা করেছি শুধু। তাতে সময়টা ওনার ভালোই কেটেছে। সেকথা লিখেছেন। আর শেষের ‘ফ্য-পা’ টুকু? ধরে নাও সে ইভেন্ট’টা না হয় ওনার সঙ্গে আমাদের পরিচয়কে মনে রাখার জন্যই ঘটল,’ হেসে বলে অহনা।
দরজায় টোকা পড়ে। সিস্টার কেক কেটে প্লেটে সাজিয়ে এনেছে। ‘এই যে, দারু-বাবুর কেক এসে গেছে!’, রমণদা হাসি মুখে বলে।
ধন্যবাদ জানিয়ে সুন্দর একটি মেসেজ পাঠিয়ে দেয় অহনা-সিঞ্চন। বলা বাহুল্য, তাদের বিয়ের সময় ভদ্রলোক’কে নেমন্তন্ন করা হয়েছিল।
বিয়ের কিছুদিন আগেই সিঞ্চনের ‘ছোটকা’ ফোন করে জানিয়েছিলেন, তার বন্ধু অহনা-সিঞ্চনের গুণমুগ্ধ। চোখের চিকিৎসার জন্য তিনি ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ওদিকে প্যারিসের সেন্ট-লুই হাসপাতাল দেবশঙ্কর’এর ছুটির আর্জি মঞ্জুর করেছে। তিনি বিয়েতে আসছেন। পুরনো বন্ধু দারুব্রহ্ম’র সাথে দেখা হবে, সেই আনন্দে তিনি আত্মহারা।