বিড়াল || তাপস বিশ্বাস

কলিংবেল বাজতে দরজা খুলল জবা। কাজের মেয়ে।

“তুই? বাড়ি যাসনি এখনও?”

“বেরতেই যাচ্ছিলাম। বউদি বলল, জবা যাওয়ার আগে একটু ময়দা মেখে দিয়ে যা, তাই।”

কথা বলতে-বলতে দরজা বন্ধ করছিল জবা।

আর্য জুতো জোড়া সু-ক্যাবিনেটে ভরে, মোজা সমেত সোজা চলে গেল বাথরুমের দিকে। বাথরুমে ঢোকার আগে পাশের ঘরে উঁকি মারল একবার। হারমোনিয়ামের রিডের উপর থুঁতনি ঠেকিয়ে বসে আছে টুকু। পোঁ-পোঁ-পোঁ করে থেমে থেমে একটা ধীর লয়ে আওয়াজ হচ্ছে সেটায়। টুকু থুঁতনিটা একবার করে ঠেকাচ্ছে, তুলে নিচ্ছে, ফের ঠেকাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, শব্দটাকে ভালোবেসে ফেলেছে সে। ঘরের অন্য পাশে আলোর নীচে দাঁড়িয়ে গান শেখাতে আসা মেয়েটার সঙ্গে কিছু একটা কথা বলছে রিনি।

আর্যকে দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রিনি বলল, “ও, এসে গ্যাছো তুমি? বাথরুমের ভিতর দেখ একটা লাল বালতি রাখা আছে। জামা-প্যান্ট-মোজা যা কিছু, সব ওটাতেই ছেড়ে রাখ। আমি মেশিনে দিয়ে দেব। ফ্রেশ হয়ে নাও, আমি চা করছি।”

আর্য বাথরুমের বন্ধ দরজার ভিতর থেকে শুনতে পাচ্ছিল, রিনি জবাকে বলছে, “সেই যখন রয়েই গেলি, কটা চটপট করে লুচি ভেজে দিয়ে যা না জবা! প্লিজ, সোনা মেয়ে আমার।”

রিনি জানে, ওভাবে না বললেও জবা লুচি ভেজে দিয়ে যাবে। অনেক না-বলা কাজ জবা নিজে থেকেই করে দিয়ে যায়। গত বছর মা মারা যাওয়ার পর থেকেই হাসিখুশি, প্রাণবন্ত মেয়েটা কেমন যেন গুম মেরে গেছে। ছেলেবেলায় নাকি বাবাকে হারিয়েছে। এখন তিন দাদার কেউই ঘাড়ে তুলতে চাইছে না। রিনিকে মাঝে মধ্যে বলে সে কথা।

“রেখে দাও, তোমারই তো সুবিধা হবে।” সাতপাঁচ না ভেবেই কথাটা বলেছিল আর্য। শুনে রিনির সে কী রিঅ্যাকশন!

“মরি আর কি! একটা ধুমসি আইবুড়ো মেয়ে চোখের সামনে সর্বক্ষণ ঘুরঘুর করবে, খুব মজা না? কিছু বুঝি না ভাবছ?”

 

সারাদিনের ক্লান্তির পর এই সময়টুকু আর্যর নিজস্ব। ফ্রেশ হয়ে এসে টিভিটাকে চালিয়ে, আর্য আয়েশ করে বসে ড্রইং রুমের সোফাটার ওপর। রাত ন’টার পর রিমোটের দখলদারিত্ব চলে যায় রিনির হাতে। প্রায় সর্বপ্রকার গানের রিয়্যালিটি শো-এর এক এবং অদ্বিতীয় বিচারক সে। প্রতিটা গানের শেষে রিনি জাজমেন্ট দেয়। টিভির ভিতরের গায়ক-গায়িকারা নিজেদের অজান্তে সেই জাজমেন্ট মাথা পেতে নিয়ে ব্রেক নিতে যায়।

টিভিটাকে মিউট করে দিয়েছে আর্য। পাশাপাশি দুটো ঘর থেকে দুই রকমের আওয়াজ আসছে তার কানে। একটা ঘর থেকে ভেসে আসছে একরত্তি বাচ্চার একটা অসহায় আর্তি। অন্যটার থেকে ছ্যাঁক-ছ্যোঁক, টুং-টাং আওয়াজ।

আর্য দেখল, ফুলকো ফুলকো লুচির একটা প্লেট এগিয়ে আসছে তার দিকে। ওমা, কাছে আসতেই প্লেটটা কেমন যেন সুইং করে চলে গেল পাশের ঘরটায়। যেন কান ছুঁয়ে দিয়ে রিনি বলে গেল, “একটু সবুর কর, দিচ্ছি তোমায়। আগে টুকুর গানের দিদিমণিকে দিয়ে আসি। মেয়েটা এক্ষুনি চলে যাবে বলছে।”

আর্য পরপর সার্ফ করতে থাকল খবরের চ্যানেলগুলো। দূর ছাই! কোনও চ্যানেলেই খবরের চিহ্নমাত্র নেই। সব কটায় বিজ্ঞাপন। আর্য লক্ষ করেছে, চ্যানেলগুলো ইচ্ছে করেই বিজ্ঞাপনগুলো একসঙ্গে দেয়।

একটু পরেই লুচির প্লেট আনল রিনি। সঙ্গে পনিরের গরম তরকারি, আর একটু ফ্রিজের ঠাণ্ডা পায়েস।

গরম লুচির সাথে ঠাণ্ডা কনকনে পায়েস দারুণ লাগে আর্যর। প্রথম প্রথম রিনি নাক সিটকাতো। একদিন খেয়ে বলল, “উরিব্বাস!”

“এই নাও, এটা খাও। চা দিচ্ছি।”

রিনিকে বেশ উৎফুল্ল লাগছে আজ। গুন গুন করে একটা সুর ভাজছে মনে হল। নিশ্চয়ই ওর পিসতুতো বোন এবারেও পি এস সি কোয়ালিফাই করতে পারেনি। আর্যর হঠাৎ মনে পড়ল, সত্যিই তো! আজই তো পি এস সি-র রেজাল্ট ছিল। নির্ঘাত তাই হবে। প্রথমবার ওর বোন কোয়ালিফাই না করায়, ওঃ, সে কী উল্লাস করে উঠেছিল রিনি! ফোনটা রেখেই বাচ্চা মেয়েদের মতো লাফিয়ে উঠেছিল। অথচ, তার একটু আগেই ফোনে বোনকে বলছিল, “একদম ভেঙে পরবি না। আমরা কেউ পারিনি। জানবি, আমাদের জন্যই তোকে পারতে হবে, বুঝেছিস?”

আর্য আবাক হয়ে যখন জিজ্ঞাসা করেছিল, তখন রিনি বলেছিল, “সব বিষয়ে এত কৌতূহল কেন তোমার? এসব মেয়েদের ব্যাপার, তুমি বুঝবে না।”

“রবিবারে আসে না? তাহলে আজ হঠাৎ?” লুচিতে কামড় বসিয়ে বলল আর্য।

“হ্যাঁ, ফোন করেছিল। বলল, রবিবার কি একটা কাজ আছে, আসতে পারবে না। আমি আজকেই আসতে বলে দিলাম। এখন গানের ক্লাস একদম মিস করা যাবে না। এমনিতেই টানা ছয়মাস বন্ধ ছিল সব। টুকুটাকে তো চেন, নিজে থেকে একটুও বসতে চায় না। আমি ভাবছি, এই মাসটা স্বপ্নাকে দু’দিন করেই আসতে বলব। একমাসে টুকু তাহলে অনেকটা তৈরি হয়ে যাবে।”

গত দুইবছর ধরে টুকু গান শিখছে। স্ত্রীর জোরাজুরিতে আর্য খুঁজে খুঁজে একজন বয়স্ক মহিলাকে জোগাড় করেছিল। ভদ্রমহিলা ক্ল্যসিকাল করান। একবছর পর আচমকা একদিন যাওয়ার সময় মহিলা বলে যান, বিশেষ অসুবিধা থাকায় তিনি নাকি আর আসতে পারবেন না। আর্য বুঝতে পেরেছিল আসল কারণটা। তারপরেই তো লকডাউনটা শুরু হল। সব বন্ধ। তিন মাস হল, রিনি কোথা থেকে মেয়েটাকে জোগাড় করেছে। গান শিখিয়ে বলে বিরাট নামডাক নাকি তার। নিজেরই ব্যান্ড আছে। এখন নেহাত সব বন্ধ, তাই গান শিখিয়ে বেড়াচ্ছে।

“কি করবে টুকু একমাস পর?”

রিনি চোখের ইশারায় দেখাল সেন্টার টেবিলটাকে। একটা গোলাপি রঙের কাগজ রাখা আছে সেখানে।

“কি ওটা?”

“অডিশন ফর্ম।”

হাত ধুয়ে এসে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে-মুছতে আর্য বলল, “তুমি পেলে কোথা থেকে?”

“ওই তো! তুমি তো কোনও খোঁজই রাখ না। স্বপ্নার এক বন্ধু জোগাড় করে দিয়েছে। তুমি এটা ফিলাপ করে দিও। স্বপ্না পরে যেদিন আসবে, নিয়ে যাবে। জমা করার ব্যবস্থা ওই করবে বলেছে।”

“তো, টুকুর মধ্যে কাকে খুঁজে পেলে? কিশোর না অরিজিত?”

আর্যর খোঁচাটা খেয়ে আহত বাঘিনীর মতো তাকাল রিনি। ঝাঁপিয়ে পড়তে যাবে, এমন সময় টুকুর গানের দিদিমণি কানে ফোন ধরে বেরিয়ে এল ভিতরের ঘর থেকে। ফোনে তীক্ষ্ণ আওয়াজে বাজছে – ‘আগার তুম মিল যাও জামানা ছোড় দেঙ্গে হম্‌…”

“হয়ে গেছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি। প্লিজ, একটু দাঁড়াও।”

ফোন রেখে আর্যর সামনে এসে দাঁড়াল মেয়েটি। বলল, “ব্যাপারটা আসলে প্রেজেন্টেশন। ওটাই সব। রিয়্যালিটি শো-তে আর অন্য কিস্যু দেখা হ্য় না দাদা। ওসব সুর-তাল-ছন্দ কে চায়? পাবলিক জাস্ট এক ঘণ্টার একটা ড্রামা দেখতে চায়। গানটাকে নয়, আসলে দেখা হয় যে গাইছে, তাকে। রঙিন জামাকাপড় পরিয়ে, মাথায় ক্রিম লাগিয়ে, উজ্জ্বল আলোর নীচে ফেললে, নিজের ছেলেকে আপনি নিজেই চিনতে পারবেন না দাদা। আসছি, রিনিদি। যা বললাম খেয়াল থাকে যেন, সোহমের খাদে কিন্তু এখনও প্রবলেম রয়েছে। খেয়াল রাখবেন। দু’বেলা নিয়ম করে বসে যেন। আজ চলি তাহলে।”

মুখ থেকে কিছুটা বার করে, বাকিটুকু ভিতরে রেখে রিনির স্বপ্ন নিয়ে যেন ঝড়ের গতিতে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল স্বপ্না। পিছু পিছু সকালের মিইয়ে যাওয়া বাসি ফুলের মতো এল জবা। বলল, “আমিও যাব এবার।”

দরজার কাছে বসে থাকা বিড়ালটা সমানে নড়াচড়া করছে। একটুও স্থির হয়ে বসছে না। সোহমের আঁকতে অসুবিধা হচ্ছে। সোহম চকিতে ভিতরের ঘরের দিকে তাকাল। তারপর উঠে গিয়ে কাচের বাটিটা উলটে দিল বেড়ালটার পায়ের কাছে। ব্যাস! ব্যাটা একেবারে চুপ। মহানন্দে বসে বসে পায়েস খাচ্ছে।

হঠাৎ একটা ম্যাজিক হল যেন! সোহমের পায়েস চেটেপুটে খেতে খেতে ধীরে-ধীরে বিড়ালটা সোহম হয়ে যেতে থাকল। আর টেবিলের ওপর বসে যে এতক্ষণ আঁকছিল, সে হয়ে গেল বিড়াল।

বিড়ালটা এখন নিজেকেই নিজে আঁকছে। গায়ের রং মিশমিশে কালো। চোখদুটো টকটকে হলুদ।

বিড়ালটা নিজেকে আঁকতে আঁকতে মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে ভিতরের দিকে দেখছে। সেখানে আরও দুটো বিড়াল চেঁচাচ্ছে।

“অযথা ঘাঁটাচ্ছ কেন ওকে তুমি? ওকে ওর মতো করে বড় হতে দাও।”

“অযথা? নিজের ছেলের ভালো চাওয়াটা অযথা মনে হচ্ছে তোমার কাছে?”

“ওর কোন ভালোটা চাইছ তুমি শুনি?”

“কী বলছ? একবার টিভিতে অ্যাপেয়ার করতে পারলে বুঝতে পারছ, সোহমের জীবনটা কেমন বদলে যাবে?”

“কি রকম বদলে যাবে? এখন দু’পায়ে হাঁটে, তখন চার পা গজাবে? আর গানটা কিছু নয়, টিভিতে দেখাবে সেটাই আসল? হায়রে! মাটিতে নেমে এসে দাঁড়াও রিনি। এতখানি অবুঝ, তোমাকে তো দেখিনি এর আগে কখনও আমি!”

“এতে অবুঝের তো কিছু নেই। সমস্ত মায়েরাই তাদের বাচ্চাদের নিয়ে কিছু না কিছু করছে…”

“তাই বল! ছেলের জীবন বদল-টদল কিছু না, অন্য মায়েদের টেক্কা দেওয়াটাই হল আসল কারণ।”

“মানে? কি বলতে চাইছ তুমি?”

“আমি কিছু বলতে চাইছি না, বলতে চাইছ তো তুমি, রিনি। বল, ছেলের নয়, আসলে নিজের জীবনটাকে বদলাতে চাইছ তুমি। তোমাদের ওই ‘ইন্সপ্যায়ারিং মমস্‌’ না কি যেন গ্রুপ আছে একটা, যেখানে এ ওকে ফেলে দেওয়ার জন্য অদৃশ্য থেকে নিজেরা দড়ি টানাটানি খেলছ সর্বক্ষণ, ছেলেকে যেনতেন প্রকারে টিভিতে দেখিয়ে, তুমি আসলে সেখানে নিজের উচ্চতাটাকে একটু বাড়িয়ে নিতে চাইছ। কি, তাইতো?”

“ছিঃ নিজের ছেলের ভালো যে সহ্য করতে পারে না, সে কেমন বাবা? স্বপ্না নিজে আমাকে বলেছে, সোহমের সম্ভবনা আছে।”

“চমৎকার! নিজের ছেলের সম্ভবনার কথা তোমাকে অন্য কারোর কাছ থেকে জেনে নিয়ে তারপর বিশ্বাস করতে হচ্ছে। তুমি নিজে জান না? নিজে বোঝো না, গানের নামে যে বাড়াবাড়িটা করছ, আদৌ সেটা তোমার ছেলে মন থেকে চাইছে কিনা? ওর মনের ভিতর ঝুঁকে দেখেছ তুমি? যেটা ওর গলা বেয়ে উঠে আসে, সেটা গান নয় রিনি। একটা চাপা আর্তনাদ! মা হয়ে সেটা বোঝো না তুমি? বাইরে সবার সামনে ওকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে যেও না, প্লিজ।”

“আমি জানতাম, ঠিক বাগড়া দেবে তুমি। ভেবেছিলাম, নিজে কিছু করতে পারিনি, ছেলেটা অন্তত…আসলে তুমিই মধ্যবিত্ত মানসিকতার! তুমি নিজে একটা ব্যর্থ মানুষ, তাই…তাই তুমি সমস্ত মানুষকেই ব্যর্থ দেখতে ভালোবাসো…”

পায়েসটুকু খেয়ে নিয়ে সোহম আবার নড়াচড়া শুরু করেছে। সে আরও চায়। তার খিদে মরেনি।

বিড়ালটাও তাকে আর আঁকতে পারছে না। সোহমকে স্থির করাটা ভীষণ প্রয়োজন।

এই সময় বিড়ালটা হঠাৎ দেখল, টেবিলের ওপর একটা গোলাপি রঙের কাগজ। ঘরের ফ্যানের হাওয়ায় নড়ছে। সোহম জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে আছে কাগজটার দিকে। কে জানে, হাওয়ায় নড়তে দেখে হয়ত প্রজাপতি-টতি কিছু একটা ভাবছে। বিড়াল তো, তাই মাথায় কিস্যু নেই। যাই দেখে, ভাবে খাওয়ার জিনিস।

তবে এই গোলাপি কাগজটার জন্যই ভিতরের মানুষদুটো বিড়াল হয়ে গেছে। সে নিজেও। গানের মিস এই কাগজটাই দিয়ে গেছে মাকে। তারপর থেকেই…

বিড়ালটা উঠে গিয়ে কাগজটা ভাঁজ করে দিয়ে দিল সোহমের মুখে।

ব্যাস! তারপর থেকে সে কী দৌড়! সোহম যেন থামতে ভুলে গেছে। দৌড়োতে দৌড়োতে হলুদ চোখদুটো দিয়ে যেন আগুন ঝরছে তার। যেন সে ফিরবে না এ পাড়ায় আর কোনওদিন।

পিছনে তখন একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছিল প্রিয় ড্রইং খাতাটার ভিতর আঁকা একটা ক্ষতবিক্ষত মুখ।

১ Comment

  1. Sorti sir darun lekha ta

Leave a Reply

Your email address will not be published.