নীড় || মানস দত্ত

সুরঞ্জন পারিবারিক জায়গা জমি বেঁচে এখন মস্ত এক কোম্পানির মালিক। স্কুল, কলেজ, আবাসন সবই আছে তাদের কোম্পানির । চরম ব্যস্ততার মধ্যে তার দিন কাটে। অফিসে নতুন কাজের জন্য প্রতি দিনই প্রায় কেউ না কেউ বায়োডাটা দিয়ে যায়। সুরঞ্জন এর অফিসে নিয়োগের জন্য তাদের মধ্যে থেকে কয়েক জনকে ইন্টারভিউ এর জন্য ডাকা হয়েছে। সুরঞ্জন নিজেই ইন্টারভিউ এর মাধ্যমে লোক নিয়োগ করেন, তাই সুরঞ্জনের সময় মতো ইন্টারভিউ এর দিন ঠিক করা হলো ।

সুরঞ্জন ইন্টারভিউ নিচ্ছেন বেশ খোশ মেজাজে। এক জন সুন্দরী যুবতী ইন্টারভিউ এর জন্য এলেন। সুরঞ্জন প্রথমে একটু অন্যমনস্ক থাকলেও মুখ তুলতেই সেই মেয়েটির সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করলো। মেয়েটি যে রূপসী তা ঠিক বলা  যায় না। গায়ের রঙ যে একেবারেই দুধে আলতা তাও নয়। চোখ, নাক যে একেবারে নিঁখুত তাও ঠিক নয় , তবে এক আদিম সৌন্দর্যের অধিকারি। নিছক সাস্থ্যের অধিকারি। বুক, কোমর, উরু সব কিছুই যেন একে অপরের পরিপূরক। মুখ চোখ দেখে মনে হয় সৎ। আর যা কিছু সৎ তার প্রতি মানুষের এক গোপন শ্রদ্ধা আছে । সুরঞ্জন মেয়েটির শরীরের দিকে না তাকিয়েও যেন পারছে না। তার দৃষ্টিতে লোভ আছে।

আগে বহুবার ইন্টারভিউ নিয়েছে কিন্তু এমনটা তার আগে কখনো হয়নি। সুরঞ্জন অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত মেধাবী ছাত্র ছিলো। স্কুল , কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে স্থান অধিকার করতো। প্রতিভাবান পুরুষ।  ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে তার এই ব্যবসা শুরু। সুরঞ্জন বরাবরই স্বাধীনচেতা , কেরিয়ারিস্ট। বহু সুন্দরী নারী তাকে টলাতে পারেনি কিন্তু আজ তার এমন কি হলো ?

সুরঞ্জন সৎ, উদার, দয়ালু মানুষ । সমাজে প্রতিষ্ঠিত একজন সজ্জন ব্যক্তি । নিজের পরিবারের পাশাপাশি অনেক পরিবার তাঁর কোম্পানির উপর নির্ভরশীল , সুরঞ্জন তাদের সবার প্রতি সুবিচার করে । কিন্তু আজ নিজের মনের কাছে সে স্বীকার করলো ঐ মেয়েটির প্রতি সে আকৃষ্ট হয়েছে । মনের মধ্যে মেয়েটিকে ভোগ করার জন্য নিম্নচাপের মতো এক ঝরো হাওয়া বইছে থেকে থেকে। সবার অলক্ষ্যে সে উপভোগ করছে মেয়েটির সাস্থের সৌন্দর্য। এক বার যদি ওর সারা শরীরে হাত বুলোতে পারতাম তাহলেই যেন শরীর মন যেন শান্ত হতো। তার মনের ইচ্ছা সবাই জানতে পারলে সবাই যেন ছি ছি করে উঠবে। সুরঞ্জন এক মুহুর্তে মন থেকে সে চিন্তাকে তাড়িয়ে দিয়ে একটু নড়ে চড়ে বসলো।

সুরঞ্জন নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করতে লাগলো আমার থেকে এতো কম বয়সী একটা মেয়ের প্রতি এভাবে তাকানোটা ঠিক ? আমি কি সত্যিই সৎ ? না অসৎ ? আমি এরকম ভাবে একটি মেয়েকে দেখছি কেনো ? কেনো না তাকিয়ে পারছি না ? আমার কি কাম প্রবৃত্তি বেড়ে গেলো ?  এটা কি দোষের ? আমি তো পাষন্ড নই । আমার স্ত্রী,বৃষ্টির কাছে আমি ছোটো হয়ে যাবো। মানুষের আদিম মূল্যবোধ এভাবেই  মাঝে মাঝে সজাগ হয়ে ওঠে হয়তো ।

মেয়েটি ধীর পায়ে চলে গেলো ইন্টারভিউ রুম থেকে। সুরঞ্জন এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল যতক্ষন না মেয়েটি সম্পূর্ণ আড়াল হলো। তার চোখ এখন শান্ত লোভহীন। সুরঞ্জনের এক বিশ্বস্ত সঙ্গী সুরঞ্জনের কানে কানে বললো, স্যার মেয়েটির সাথে কথা বলবো ? চাকরীর জন্য রাজি হয়ে যাবে হয়তো। সুরঞ্জন রুক্ষভাবে তাকিয়ে দৃঢ় ভাবে বললো এটা বেলেল্লা করবার জায়গা না। তখন মনে এক প্রশান্তভাব কাজ করছে । এসি রুমেও এক পশলা ঝিরঝিরে হাওয়া বয়ে গেলো। সুরঞ্জনের চোখে মুখে এক অসীম উজ্জ্বলতা,  নদীর জলে সূর্যের আলো পরলে যেমন চকচক করে ঠিক তেমনি । সে যেন আজ এক গোপন রহস্য ভেদ করেছে নিজের অজান্তে ।

অফিসের সমস্ত কাজ সেরে সুরঞ্জন বাড়ি ফিরে হাত মুখ ধুয়ে তার একমাত্র ছেলে বাবুন কে একটু আদর করে সোফায় গিয়ে বসলো । তাঁর স্ত্রী বৃষ্টি চা দিয়ে গেলো । সুরঞ্জন অপলক দৃষ্টিতে বৃষ্টির দিকে অল্প সময় চেয়ে রইলো । ছাদে গিয়ে সিগারেট ধরালো সুরঞ্জন। আকাশ ভর্তি তারা , দূরের দেবদারু গাছটায় জোনাকি গুলো আলোর খেলা খেলছে। বাগান থেকে  এক সরু হাওয়া ধীর গতিতে তাকে ছুয়ে যাচ্ছে বারবার, ভারি চমৎকার সেই সৌন্দর্য। খোলা আকাশের দিকে মাথা তুলে , সেই সোন্দর্যের দিকে তাকিয়ে সুরঞ্জন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, অপদার্থ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.