ছেঁড়া সুতো || অমৃতা ব্রহ্ম

ঘড়িতে ন’টা বেজে পাঁচ। দোতলার ব্যালকনির কাঁচের দরজায় মে’ মাসের চড়া রোদের ঝলক।

অয়ন, অয়ন দত্তগুপ্ত, সেনগুপ্ত ট্রেডিং এর মালিক তথা এম.ডি অফিসের ধড়াচূড়ো পরে ডাইনিং টেবিলে এসে বসতে না বসতেই কাকলি বাটার টোস্টের প্লেটটা স্বামীর দিকে এগিয়ে দিয়ে অরেঞ্জ জ্যুসটা গ্লাসে ঢেলে ফেলল। এই সময়ে অয়ন একদম দেরী পছন্দ করে না, নিয়মের ব্যতিক্রম তো নয়ই।

অবশ্য কোন সময়েই বা করে? মাপা হাসি, মাপা সোহাগেই তো কেটে গেল ন’টা বছর। অয়ন ঠিক তার মায়ের মতোই। অসম্ভব ধনীকন্যা এবং প্রখর ব্যক্তিত্বশালিনী মহিলাটি গত হয়েছেন বছর ঘুরে এল প্রায়। কাকলির মনে পড়ে, সেই নিয়মানুবর্তিতা ….ব্যবহার … শাসন….স্নেহ —- এইখানে এসে মনে মনে একটু থমকায় সে, এই স্নেহ জিনিসটা উক্ত মহিলার চরিত্রে ছিল কি?কাকলি অন্তত কোনোদিন তার আভাসটুকুও পায়নি। স্নেহশীল ছিলেন শ্বশুরমশাই। এই বাড়িতে তিনিই একমাত্র আশ্রয় ছিলেন তার।আর সেই মানুষ ……

শ্বশুরমশাইয়ের কথাটা মনে পড়তে চটকা ভাঙল কাকলির। অয়নের ততক্ষণে ব্রেকফাস্ট শেষ। পেপার ন্যাপকিনে মুখ মুছছে। এবার বেরোবে।

“কাল বাবার একটা চিঠি এসেছে। খুলিনি।তোমাকে দেওয়াও হয় নি। একটু দাঁড়াও!আনছি।….” বলতে বলতে দ্রুত শোবার ঘর থেকে খামটা এনে অয়নের হাতে দিতে যেতেই স্বামীর মানসিক উত্তাপের আঁচে যেন ঝলসে গেল কাকলি। অয়নের টকটকে ফরসা মুখ রাগে যেন লালচে হয়ে উঠেছে। আগুন বেরোচ্ছে পিঙ্গল দুই চোখের তারা থেকে। সদ্য জুতো পরেছে। হাতের সু-হর্ণটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে উঠল অয়ন,

“তুমি!….তুমি! ঐ লোকটার চিঠি আমার পড়ার জন্য রেখে দিয়েছ।! ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারনি?….”

“উনি তোমার বাবা হন,অয়ন!”

কাকলির আর্তস্বরকে বিদ্রূপ করে অয়নের গলা বেজে ওঠে—-

“বাবা বৈ কী! জন্ম দিয়েছে যখন!বাবার কোনো কর্তব্যই তো বৈশ্বানর দত্তগুপ্ত করেনি।শেষটায় মা-র মৃত্যুর একমাস কাটতে না কাটতেই ……

দরজায় ড্রাইভার নান্টু ব্যাগ নিতে এসে দাঁড়াতে অয়নের মুখ থেকে উদগীর্ণ লাভাস্রোত বাধা পেল। নিখুঁত নিয়মানুবর্তিতায় বিশ্বাসী অয়ন দত্তগুপ্ত রোজকার মত স্ত্রীকে ‘পার্টিং কিস’ করে বেরিয়ে যেতে কাকলির একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল, ” …..ঠিক মায়ের মতো ।”

দরজা বন্ধ করে পায়ে পায়ে ঘরে এসে বসে কাকলি। অবশ্য বাড়ি এখন ফাঁকাই।ওয়ার্ল্ড স্কুলের ছাত্র, ছেলে বুবাই সামার ক্যাম্পে। বাড়িতে থাকলেও মায়ের ঘরের কাছাকাছি বিশেষ দেখাও যায় না তাকে। ল্যাপটপই তার প্রিয় সঙ্গী। ভবিষ্যৎ ও কেরিয়ার বিষয়ে এই বয়সেই যথেষ্ট সচেতন সে।

কুক পঞ্চানন রান্নাঘরে। সর্বক্ষণের সহায়িকা প্রতিমা বোধহয় কাপড় কাচছে।মনিবপক্ষের কোনো কথায় থাকাটা এবাড়ির শিক্ষা নয়।নিয়মের পান থেকে যৎসামান্য চুন খসলে চাকরি যাওয়া অবধারিত, জানে তারা।

তবুও কাকলি দরজাটা বন্ধ করে সন্তপর্নে খামটা খোলে।শ্বশুরমশাইয়ের সেই পরিচিত হস্তাক্ষর–

স্নেহের অয়ন,

” অবশ্য জানিনা তোমাকে স্নেহ করার অধিকার আছে কিনা আমার। তাও লিখলাম।

“আমি জানি, তোমার মায়ের মৃত্যুর একমাসের মধ্যে,কোনো কারণ না দেখিয়ে আমার গৃহত্যাগের জন্য তোমাকে সমাজে হয়তো ছোট হতে হয়েছে, কেউ কিছু বলেছে হয়তো। কিন্তু আমার আর উপায় ছিল না, জানো। আমার রোগজর্জরিত বাবা মেয়ের বিয়ের টাকা যোগাড় করতে, সদ্য শিক্ষকতার চাকরি পাওয়া পঁচিশ বছরের ছেলেকে যখন তাঁর ধনকুবের বাল্যবন্ধু দুলাল সেনগুপ্তর কাছে বিক্রি করলেন, আমি একটা অন্ধকূপের ভেতরে তলিয়ে গেলাম।

“এ বাড়ির চাকচিক্য, বিলাসবাহুল্য, অর্থের মাপকাঠিতে মানুষকে বিচার করা আমাকে অস্থির করে তুলেছিল। আমার একমাত্র মুক্তির জায়গা ছিল আমার স্কুল, আমার ছাত্ররা। তাই তোমার দাদুর ও মায়ের শত জোরাজুরি সত্ত্বেও ব্যবসায় আমি ঢুকিনি।

“হ্যাঁ, আমি স্বীকার করি, দুলাল সেনগুপ্তের আমার প্রতি একটা করুণামিশ্রিত স্নেহ ছিল। কিন্তু, তোমার মা? তাঁর অগণিত স্তাবককূল ও তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, উচ্ছ্বল জীবনযাপন, আমার আত্মীয়দের  নিরন্তর অসম্মানে আমার আত্মসম্মান দৈনিক আহত হতো। সে খবর তোমার কাছে কোনোদিন পৌঁছয়নি। তুমি জানো, আমি তোমার প্রতি কোনো কর্তব্য করিনি। আমাকে করতে দেওয়া হয়নি। কারণ, তোমার মা বিশ্বাস করতেন,একমুহূর্তও আমার সঙ্গে তুমি থাকলে তোমার সবদিক দিয়েই অবনমন ঘটবে। তোমাকে সেনগুপ্ত কনসার্নের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী রূপে গড়ে তুলতে তাঁর এতটুকু চেষ্টার খামতি ছিল না।

 

” তবুও আমি তাঁর সম্মানের কথা ভেবেছি।স্বামী গৃহত্যাগ করলে তিনি অসম্মানিত হবেন বলে, অসহ্য এক জীবন কাটিয়েছি।অবশেষে তাঁর মৃত্যুর পর এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

” মনটাকে গুছিয়ে নিতে সময় লাগছিল। এতদিন তাই খবর দিইনি।

” বজবজের দিকে আমার বন্ধুর গ্রামের বাড়ি । বরাবরের সমাজসেবী আমার এই বন্ধু অবসর নিয়ে স্থানীয় বাচ্চাদের পড়াশোনার দিকে নজর দিয়েছে, সঙ্গে একটা বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্রও আছে। এখানেই আছি,খুব  ভালো আছি।ঠিকানা দিলাম।পারলে এসো।

ইতি….”

পুরো চিঠিটা রাখা নিরাপদ নয়। শুধু ঠিকানাটা টুকে রাখল কাকলি। এতদিন সোনার খাঁচার দরজার চাবিটা সে খুঁজে পাচ্ছিল না।তারও যে খুব খুব দরকার একটা মুক্তির ঠিকানা! অয়নের ছেলেও যে অয়নের মতোই হয়ে উঠছে!

Leave a Reply

Your email address will not be published.