একটি নক্ষত্র || অপরাজিতা ঘোষ

ছোট ছোট যে ঢেউ গুলো আসছিল, ছেলেটির পা স্পর্শ না করেই ফিরে যাচ্ছিল। ছেলেটি আরো একটু এগিয়ে দাঁড়াল।এবার জল উঠে এল হাঁটু পর্যন্ত। ঠান্ডা স্পর্শ। শিরশির করে উঠল শরীর। তখন সন্ধ্যা নামছে খুব ধীরে। নববধূর দুই ভ্রুর মাঝখানে লাল গোল টিপের মত সূর্যটা ডুবে যাচ্ছে। লাল আভা লেপ্টে আছে ঘন মেঘের গায়ে। আস্তে আস্তে নামছে অন্ধকার ..

নীল জলরাশিকে মুহূর্তে মনে হল যেন বিশাল একটা দোয়াত উপুড় করে কেউ কালি ঢেলে দিয়েছে সমুদ্রে। সেই কালো তিরতির করে নড়তে থাকা জলরাশির দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইলো ছেলেটি। তারপর ছুটে গিয়ে মুখ লুকাল মায়ের কোলে।

সী সাইড হোটেলের বারান্দায় বসে নির্বাক আকাশটা দেখছে বিতান। হাজারবার দেখা আকাশ তবু মনে হয় অচেনা। আজই প্রথম দেখছে। হয়তো আসলে সে আকাশ দেখছেনা।আকাশের দিকে তাকিয়ে ফিরে যাচ্ছে তার শৈশবে। ছেলেবেলায় সেই একবারই সমুদ্রে এসেছিল বাবা–মায়ের সঙ্গে। তারপর আর কোনোদিন,আসা হয়ে ওঠেনি। মল্লিকা বলেছিল “যাওনা, একদিন হুট করে চলে যাও। ভাল লাগবে”

“কার সাথে যাব?”

“সাথে লাগে নাকি? বোকা! একাই চলে যাও। নয়তো বৌকে নিয়ে যাও”

“নাহ্ থাক্, যাবনা। যখন যাবার কথা ছিল, তখনই যাওয়া হলনা যখন, আর কি হবে!”

“এটা তোমার একগুঁয়েমি। তোমার এই একগুঁয়েমির জন্য জীবনে কি কি হারিয়েছ জানো?

” জানি! নষ্ট সময়কে টেনে টেনে ভাল সময়ে নিয়ে আসতে পারিনি। রিয়ার পেটের বাচ্চাটা নষ্ট করার সাহসী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে পারিনি। তোমাকে স্বামীর শেকল থেকে মুক্ত করতে পারিনি। খুব সাহস করে কাছেও টানতে পারিনি। এমন আরো কত না পারা আছে” মল্লিকা একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে থাকল। বিতানের চেনা মুখটা যেন নতুন করে দেখছে। ভেতরে ভেতরে সেও কষ্ট পায়, মায়া হয়, কিন্তু যখনই বোঝে, এ মায়ার দাম দিতে হলে তাকে একটা বড় রকমের চড়াই–উতরাই পেরোতে হবে, তখন পরিণত বয়স তাকে হ্যাঁচকা টানে থামিয়ে দেয়। কিছুতেই আর সে এগোতে পারেনা। বিতান বলে, “আমারও ভাবনা আসে কোনো কোনো গভীর রাতে। মনে হয়, এই সমাপ্তিহীন পথের শেষ কোথায়!

বিতানের কথাঃ

আগে আমরা থাকতাম শিমুলতলী স্টেশনের গায়ে ছোট্ট একটা মফস্বল শহরে। শহরতলি হলেও এখানে একটা সুন্দর গ্রাম্য গন্ধ ছিল। একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা,এ ওর হাঁড়ির খবর নেওয়া, বিপদে আপদে ঝাঁপিয়ে পড়া, এগুলো সেখানে ছিল। মা চলে যাবার পর বাবা আমাকে নিয়ে উঠে এলেন বরানগরে। ভর্তি করে দিলেন নরেন্দ্রনাথ হাইস্কুলে। এখানে আমি ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়েছিলাম। নতুন পাড়ায় আমার কোনও বন্ধু হয়নি। স্কুল না থাকলে আমি বাড়ির সামনের ছোট্ট এক টুকরো বারান্দায় বসে থাকতাম। বিকেল হলে ছাদে। একা একা আমার খুব কান্না পেত। আমি কাঁদতাম। চিৎকার করে কাঁদতাম। কিন্তু কোন শব্দ হতনা। আমার কেবলই মনে হত, পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনও অর্থ নেই। এখানে বেঁচে থাকা মানে, এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা বকের বিষণ্ণতা। সেই কবে থেকেই দেখতাম, বাবার সঙ্গে মায়ের কোন বনিবনা ছিলনা। দুজনের মতামত সবসময় দুরকম। আমি ছিলাম বাবার দলে। বাবাই আমার কাছে শ্রেষ্ঠ পুরুষ।  মায়ের ধারে–কাছে খুব একটা ঘেঁষতাম না। মা দুহাত বাড়িয়ে আমায় ডাকত। যেতাম না! মনে হত আমাদের বাড়িতে যে অশান্তি, তার মূল কারণ মা। মা কেন মানিয়ে নিতে পারেনা? আমার চোখে বাবার কোন ভুল ছিলনা। তাই মনে হত এমন একটা মানুষকে মা কষ্ট দেয় কেন! মা কেন নিজের ইগো থেকে বেরিয়ে এসে সব ঝামেলা মিটিয়ে নেয়না? মা তো আগে এরকম ছিলনা। আমরা তিনজনে কত ভাল সময় কাটাতাম! মা কি ভুলে গেল সব? তারপর একদিন আমাদের ছেড়ে চলে গেল মা। এতে বাবার কোন প্রতিক্রিয়া দেখলামনা। আমারও একটুও খারাপ লাগছিলনা। মনে হচ্ছিল ভালই হয়েছে। যে মায়ের কারণে আমার বাবাটা ভাল থাকছিলনা, সেই মায়ের জন্য কষ্ট কি! বরং আমি এখন অনেক খুশিতে থাকতে পারব।বাবাকেও নিশ্চয়ই হাসিমুখে দেখতে পাব।বাবার সাথে আবার আমি হেসে খেলে বেড়াব। বাবার পাশে ছাদে বসে রাতের আকাশ দেখব,সাঁতার কাটব, ক্রিকেট খেলব। অথচ খেয়াল করলাম, বাবাকে ঠিক যেভাবে ফিরে পেতে চাইছিলাম, ঠিক সেভাবে যেন পাচ্ছিনা। কেন! মায়ের চলে যাওয়াটা কি বাবা ভুলতে পারছিল না? বুকের একপাশে কি চিনচিনে ব্যথা রয়ে গেছে তাঁর? হায় ভগবান! যার কারণে মানুষটা সুখের দেখা পায়নি এতগুলো দিন,তাঁর জন্য কিসের এত শোক?

শীত পেরিয়ে বসন্ত চলে এল। বেশ কিছুদিন  মল্লিকার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। মল্লিকা আমার প্রথম ও একমাত্র প্রেম। কিন্তু মায়ের মত ওকেও আমি ধরে রাখতে পারিনি। তবুও  এবার বসন্তে যখন প্রথম কোকিল ডাকল, আমার খুব ইচ্ছে  হচ্ছিল মল্লিকাকে কাছে পেতে। আমি আমার ভেতরে বাসা বাঁধা আয়ুক্ষয়ী কষ্টটাকে প্রাণপণে ভুলে থাকতে  চাইছিলাম যা আমাকে নিশ্চিত ভাবেই একটু একটু করে শেষের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমি জানি একদিন না একদিন কোনো মাহেন্দ্রক্ষণে আমার মাথার ভেতরে জন্ম নেওয়া অবসাদটি বড় হবে। ক্রমশঃ আরো বড়। আর কাউকে বিরক্ত না করেই আমাকে শেষের প্রান্তে নিয়ে যাবে। যেখান থেকে আর কেউ আমায় ফেরাতে পারবেনা। মল্লিকা না, রিয়াও না। এই কষ্টের ভাবনাটাকে  আমি আস্তে আস্তে জয় করে ফেলেছি। মল্লিকা ঠিক করেছিল আসবে। আমিও মনে মনে খুব চাইছিলাম মল্লিকা আসুক। শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত মানুষ ছুটে গেল, একে অপরের কাছে আসল, আবার দূরে চলে গেল! কিন্তু মল্লিকার আর কিছুতেই আসা হয়ে উঠলনা। পরকীয়া ব্যাপারটা বোধহয় এমনি, খুব লুকিয়ে ভালবাসতে হয়।প্রেম–বিয়ে–সন্তান জীবনকে সুমধুর করে। তারপরেও হতচ্ছাড়া হৃদয় পরকীয়ায় লিপ্ত হয়।

একদিন কোনো একটা প্রয়োজনে বাবার ঘরে ঢুকেছিলাম। এমনিতে আমার ওঘরে যাওয়া আসা একেবারেই হয়না। তখন আমি সবে সবে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হয়েছি। তল্পিতল্পা গুছিয়ে হোষ্টেলে চলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম বাবার টেবিলে, ছোট্ট একটা ডায়েরি। ছোট,কিন্তু খুব সুন্দর। বেরিয়ে আসব আসব করেও লাল কভারে বাইন্ডিং করা ডায়রিটার প্রতি অদ্ভুত একটা আকর্ষণ বোধ করলাম। টেবিল থেকে ওটা তুলে নিতেই বেকায়দায় কয়েকটা কাগজ নীচে পড়ে গেল। সব একে একে তুললাম। কাগজগুলো সাবধানে আবার ডায়েরির ভেতরে রেখে দেওয়ার পর দেখি,ভাঁজ করা একটা কাগজ আমার পায়ের কাছে পড়ে আছে। তুললাম! নিছকই কৌতূহলে। কাগজটা আদৌ কাজের না অকাজের দেখার জন্য ভাঁজ খুললাম। দেখি, মায়ের হাতের লেখা, বাবাকে! আমার কৌতূহল দ্বিগুণ হয়ে গেল। ব্যাপারটা এমন নয় যে আমি কোনোদিন কাউকে চিঠি লিখতে দেখিনি। কিন্তু বাবাকে চিঠি লিখেছে “মা”! কেন? কি কারণে?

ভাবতে ভাবতেই চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম। বিষয়টা উচিত না অনুচিত, তা ভেবে দেখার কথা মাথায় আসেনি। কিন্তু পড়াটা শেষ করতে পারলামনা। তার আগেই আমার মাথাটা বনবন করে ঘুরতে লাগল। মনে হল, চারিদিকে কেবল শূন্যতা, অন্ধকার। আমি যেন অনিঃশেষ অতলান্তে হারিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ অনুভব করলাম, নিজের ভেতরে ক্রমশ একটা ঘৃণা জন্ম নিচ্ছে। যার মায়ার বাঁধনে আটকে থেকে এই পৃথিবীতে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিলাম, যাকে ভেবেছি শ্রেষ্ঠতম মানুষ। তাঁর প্রতি এত ঘৃণা বোধ করছি কেন! তবে কার কাছে যাব আমি? কার হাত ধরে এই অন্ধকার থেকে উঠে আসব?

একটা ছন্দপতন ঘটে গেল। ঘুড়ি যেমন সূতো  ছেঁড়বার পরেই কোথাও হারিয়ে যায়, আমিও তেমন হারাতে বসেছি। আমার সূতোটাও আলগা হয়ে গেছে ! কাল বাদ পরশু আমার ব্যাঙ্গালোরে চলে যাবার দিন। তার আগে আমাকে কিছু একটা করতে হবে। ক্ষমা চাইতে হবে মায়ের কাছে। কাগজ কলম নিয়ে বসলাম।

“প্রিয় মা,

তুমি তো খুব ভাল করেই জান, মাকে কখনো আলাদা করে প্রিয় ডাকতে হয়না। মায়েরা তাদের সন্তানদের কাছে সব সময়ই প্রিয়। তাহলে আমার বেলায় কেন সব এমন ওলোট–পালট হয়ে গেল মা? আচ্ছা মা, তুমি কি রাগ করে আছ আমার ওপর? আমার জন্য কি শুধু ঘৃণা ভাসে তোমার মায়াময় দু চোখে? আমি তোমাকে পছন্দ করতাম না বলে, তুমি খুব কষ্ট পেতে,তাইনা? বাবার কোলে মাথা রেখে কত রাত কাটিয়েছি। বাবার হাতে খাবার খেয়েই আজ আমি এত্ত বড়। তুমি আমাকে কতবার কাছে ডাকতে! হয়তো আমায় বুকে জড়িয়ে একটু আদর করতে ইচ্ছা হত, হয়তো আমার কপালে একটা গাঢ় চুমু খেতে, হয়তো রাজকন্যা আর দৈত্যের গল্পটা আবার শোনাতে চাইতে, কিন্তু আমি তোমার কাছে যেতাম না। তুমি তাই আড়ালে কাঁদতে! তাইনা মা? যেদিন তুমি বাবাকে একা রেখে, আর আমাকেও একা ফেলে রেখে চলে গেলে,আমি সেদিন বাবাকে খানিকটা মুষড়ে পড়তে দেখেছি। তবে আমার কোনো কষ্ট হয়নি। কিন্তু এখন জানো মা, আমার খুবই কষ্ট হচ্ছে। তোমার একটুখানি স্নেহ পেতে, তোমার কোলে মাথা রেখে গল্প শুনতে ইচ্ছে হয়। বাবার কাছ থেকে আমিও আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছি। “মা, তুমি কেন বাবার ওপর অত রাগ করতে, কেন তাকে ছেড়ে চলে গেছ,আমি সব জেনে গেছি“। বাবার ডায়েরিতে তোমার রেখে যাওয়া চিঠি পড়ে। মা তোমার ওপর আমার আর কোনো রাগ নেই বরং গর্বে বুকটা ফুলে উঠছে। তোমার এই সাহসী সিদ্ধান্তকে আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখছি। যেখানে বাবা তোমার মত স্ত্রী থাকা সত্বেও অন্য রমণীর বশীভূত হয়,তুমি তার ঘরণী হতে পারোনা।মা, খুব জানতে ইচ্ছে করে, তুমি কি নিজের মত করে গুছিয়ে নিয়েছ নিজের জীবন? কোন অবলম্বন পেয়ে গেছ বেঁচে থাকার জন্য?

কিন্তু আমার! আমার কি হবে মা!আমার বেঁচে থাকার অবলম্বনটা কি হবে!

তুমি খুব ভাল থেকো, ভাল থেকো, মা..”

মল্লিকা এলনা।আমি জানি,সে আসতে পারবেনা।ওকে যে শেষবারের মত একবার দেখতে চাইছি, সেটা ওকে জানাইনি।জানালে হয়তো শত বাধা–বিপত্তি ঠেলে একবার আসতো।কান্না ভেজা গলায় বলত,”তুমি কেন আগে বলনি? যদি একবার বলতে..”   আমি কাউকেই বলিনি, কাউকে না। রিয়া তো আমার খোঁজ খবর নেওয়ার প্রয়োজনটুকুও দেখায়না।সে মাল্টি ন্যাশনালে বড় পোস্টে আছে।অফিস, মিটিং, ট্যুর–এসব নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। তার সময় কোথায়! বছর পাঁচেকের বিবাহিত জীবনে কোনো টানই তৈরি হয়নি।

সেই রাতে বিতান খুব করে মল্লিকাকে অনুভব করছিল। খুব চাইছিল যদি মল্লিকা আসে, তবে তার কোলে মাথা রেখে শোবে। হয়তো সেই শোওয়াই শেষবারের মত পরিতৃপ্তির শোয়া হত।কোনো কামনা নয়, কোনো শরীরের চাহিদা নয়, শুধু মল্লিকাকে কাছে পওয়া,তার কোলে মাথা রেখে শান্তিতে লম্বা প্রগাঢ় ঘুমের রাজ্যে ডুবে যাওয়া..

অ্যাম্বুলেন্স, হাসপাতাল, অক্সিজেন এসবের জন্য যে সময়টুকু পাওয়া গেল, সেটুকু যথেষ্ট ছিলনা।বিতান যে নিজেকে এভাবে শেষ করে দেবে, কেউ বুঝতেও পারেনি। শুধু বিতান জানত যে তার শেষ হবারই কথা ছিল।বরাদ্দের শেষ সময়টুকুতে সে শেষবার চোখ মেলে যখন চাইল,আত্মীয় পরিজনদের মধ্যে কে যেন জিজ্ঞাসা করল, “কাউকে কি  দেখতে ইচ্ছা করছে?” কোনো কথা বেরোলনা মুখ দিয়ে। কিছুক্ষণ পর খুব অস্পষ্ট একটা শব্দ  জড়িয়ে জড়িয়ে বলল বিতান, “স–মু–দ্র” … একটি নক্ষত্র আমি দেখছি, সারা আকাশ জুড়ে জ্বলজ্বল করছে নক্ষত্র।আমি সেই আকাশ ভরা নক্ষত্রের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছি।  শুনেছি, মানুষ নাকি মরে গেলে তারা হয়ে যায়! আকাশের এত এত নক্ষত্রের মাঝে,কোন নক্ষত্রটি হব আমি!

Leave a Reply

Your email address will not be published.