অতীতের হাতছানি || রাখী আঢ্য

(১)

“আপনি আর একটু দেরি করলে কিন্তু কাউন্টার বন্ধ হয়ে যেত”—দ্রুত হাতে বোডিং পাস দিতে দিতে কাউন্টারের ছেলেটি বলল। রিয়া তখনো হাঁপাচ্ছে, আসলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিল ঠিক সময়ে কিন্তু দিল্লির ট্রাফিকে আটকে শেষ মুহূর্তে পৌঁছেছে। এয়ারপোর্টে কোনরকমে আইডি দেখিয়ে গেট পেরিয়ে যতক্ষণে ঠিকঠাক এগিয়ে দিয়েছে ততক্ষণে কাউন্টার বন্ধ হতে আর মাত্র ৫ মিনিট, ছেলেটির কথায় উত্তরে কোন রকমে ঘাড়টা হেলিয়ে দিয়ে হাত ব্যাগ থেকে জলের বোতলটা বার করে এক ঢোক জল খেয়ে তবে স্বস্তি।

সাইডে রাখা ট্রলি ব্যাগ টা নিয়ে লাউঞ্জের দিকে হাঁটা দিল সে,আর মাত্র এক ঘণ্টা পরেই ছাড়বে পন্ডিচেরি ফ্লাইট। দিল্লি থেকে ব্যাঙ্গালোর তারপর আবার পন্ডিচেরি, সেখানে পৌছাতে পৌছাতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। রাতটা কাটিয়ে অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে তাকে।ফ্লাইটে রিয়া তার পছন্দসই সিট পেয়েছে।তার যে কোন যানবাহনে জানলার ধারে সিট ই কাম্য, ভাগ্যক্রমে এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। যথাসময়ে ঝাঁকুনি দিয়ে প্লেনটি রানওয়ের উপর চলতে শুরু করল। এই ঝাঁকুনি র সাথে তার আবার চোখের উপর সেই দৃশ্য ভেসে উঠল যা তার কুড়ি বছরের জন্মদিনের রাত থেকে দেখতে পাচ্ছে। “চারিদিকে বালি আর বালি, মাঝখানে রয়েছে একটি বিশাল বড় রথ… হলুদ পাথরে বানানো,তার সারথির জায়গায় যিনি বসে আছেন, তাঁর এক হাতে ছোট লাঠি,আর এক হাতে ধরা রয়েছে একটি শাণিত তরবারি যার ফলাটি চাঁদের আলো পড়ে চকচক করছে ও তার রুপোলি গা দিয়ে টপ টপ করে ঝরে পড়ছে লাল রক্তের ফোঁটা। যেন সদ্য যুদ্ধ জয় করে ফিরছে, অথবা কাউকে হত্যা করে। ভয়ের আবেশে চোখটা বুজে এলেও একটা ঘড় ঘড় আওয়াজে রিয়ার সেই তন্দ্রা ভেঙে যায়।এটি আসলে বড় প্লেন নয়, জেড প্লেন টাইপ(ATR), তাই আওয়াজটা  হতেই থাকে।

সদ্য এক মাস আগে সে কুড়ি বছরে পা দিয়েছে জন্মদিনের রাতটা ভোলার নয়।সেদিন সন্ধ্যাবেলা তাদের  দিল্লির ফ্ল্যাটটি খুব সুন্দর ভাবে সাজানো হয়েছিল। একমাত্র মেয়ে রিয়ার জন্মদিন বলে কথা, সুশোভন বাবু ও সন্ধ্যা দেবীর একমাত্র সন্তান রিয়া।খুব ধুমধাম করে না হলেও রিয়া র জনা দশেক বন্ধু ও সুশোভন বাবুর কয়েকজন অফিস কলিগ ও তাদের ফ্যামিলি…এরাই উপস্থিত ছিলেন।

সেদিন ভোর বেলাতেই এক ভয়ংকর স্বপ্নে ঘুম ভেঙে গেছিল রিয়ার।এক প্রায়ান্ধকার ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সে,সামনে একটি অদ্ভুত দেবমূর্তি, যাঁর চারটে হাত,দুই হাতে অস্ত্র আর দুই হাতে তিনি ধরে আছেন এক দেবীকে, বলাবাহুল্য সেই দেবীকে তিনি জঙ্ঘার উপর বসিয়েছেন।দেবতার মুখটি গণেশের মতন অর্থাৎ হাতির মতন।শুধু সেই দেবতার মুখ টিতে হালকা আলো রয়েছে।বাকি সব জায়গা অন্ধকার।রিয়া পথ খুঁজছে বের হবার,কিন্তু পারছে না।হঠাৎ একটা কিছুতে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায়, উঠতে গিয়ে দেখে গোলমতন একটা কিছু পড়ে আছে ঘরের মেঝেতে,ওটায় হাত লেগে হাতটা চ্যাটচ্যাট করতে লাগল। ঘরটির ওপরে বোধহয় জাফরি মতন কিছু ছিল, হঠাৎ সেখান দিয়ে চাঁদের আলো এসে ওই জায়গায় পড়াতে আতঙ্কিত হয়ে পেছনে চলে আসে রিয়া।একটি মানুষের কাটা মুন্ডু, যেন সদ্য তাকে হত্যা করা হয়েছে। একটা অস্পষ্ট চিৎকার করে রিয়া ঘুম থেকে উঠে পড়ে। তার সারা মুখ ঘামে ভিজে গেছে ,গলা শুকিয়ে গেছে। কেন সে এই রকম স্বপ্ন দেখলো,আর এই আর এই মূর্তিটিই বা কোথাকার?তার সাথে রিয়ার বা কি সম্পর্ক?প্রশ্নের উত্তর হাতড়ে গেছে, কিছু পায়নি।সাইড টেবিল টা থেকে জলের বোতলটা নিয়ে জল খেয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে জানলার কাছে গিয়ে দেখে চারদিকে শুধু বালি আর বালি, শুধু মাঝখানে যে হলুদ পাথরের এক বিশাল রথ। রিয়ার গলা দিয়ে শুধু মা চিৎকার বেরিয়েছিল। সন্ধ্যা দেবী ছুটে এসে দেখেন মেয়ে মেঝেতে পড়ে আছে ।

প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগলো বেঙ্গালুরু থেকে পন্ডিচেরি আসতে। বিকেল পাঁচটা বেজে গেছে, যদিও সন্ধ্যা নামতে এখন ঢের দেরী। দিল্লি বা ব্যাঙ্গালোরের তুলনায় পন্ডিচেরি এয়ারপোর্ট় অনেকটাই ছোট। তবুও লাগেজ নিয়ে বেরোতে বেরোতে প্রায় পৌনে ছটা হয়ে গেল। এয়ারপোর্টের বাইরে জামাইবাবু সুব্রত দাঁড়িয়েছিলেন,এগিয়ে এসে ওর হাত থেকে স্যুটকেসটা নিয়ে বললেন ,”বাইরে গাড়ি আছে,চল রিয়া”। রিয়া স্মিত হেসে সম্মতি জানিয়ে সুব্রতর পিছু নিল।

সুব্রত দা তার নিজের জামাইবাবু নয়,তার মাসতুতো দিদির স্বামী সুব্রত দত্ত,পন্ডিচেরির রাজভবনে কাজ করেন।রিয়া এখানে আসবে শুনে বাবা সুব্রতদার সাথে যোগাযোগ করেন। গাড়িতে উঠে রিয়া একদম জানলার ধারে সরে বসলো, উদ্দেশ্যে বাইরে টা দেখার, নতুন শহর নতুন প্রকৃতি।সমুদ্রের পাশ দিয়ে যখন গাড়ি যেতে লাগল তখন সমুদ্রের গুরু গম্ভীর শব্দ তার মনে এক অপূর্ব মূর্ছনা সৃষ্টি করলো।পন্ডিচেরী শহর টার মধ্যে প্রাচীন ফ্রেঞ্চ সভ্যতার ছোঁয়া আছে,বলা ভালো শহরবাসী সেই ছোঁয়া বাঁচিয়ে রেখেছে।তাই এখানে এলে মনে হয় সময়টা যেন তিনশো বছর পিছিয়ে গেছে। গাড়িতে যেতে যেতে সামুদ্রিক হাওয়ায় আবেশে চোখ বুজে আসে। ফিরে আসে সেদিন জন্মদিনের সন্ধ্যাটা।

জন্মদিনের সন্ধ্যা টা বেশ জাঁকজমকপূর্ণ ভাবেই শুরু হলো রিয়ার। এক এক করে তার বন্ধুরা যখন আসতে লাগলো,এবং হাসি মজা ও  বন্ধুবান্ধবের মধ্যে কোথায় যেন ভোর বেলার সে স্বপ্নের ঘটনাটা মন থেকে মুছে যেতে লাগলো। সম্রাট যখন এলো তখন তো রিয়ার বন্ধুরা ওকে নিয়ে মজা করতে লাগলো। সম্রাট যে রিয়াকে পছন্দ করে তা কলেজের সবাই জেনে গেছে। রিয়াও জানে সেকথা।  রিয়ার সম্রাটকে ভালো লাগলেও তাকে জীবনসঙ্গী করার কথা চিন্তা তেও আনতে পারে না। কোথাও যেন তার চোখদুটো কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, কিন্তু পাচ্ছে না। সে দুঃস্বপ্নটাকে ভুলতে চায়, কিন্তু পারছে না। ঐ স্বপ্ন যে তার পিছু ছাড়েনি,তা সে পরের ঘটনাতেই বুঝতে পারলো।

কেক কাটা হয়ে গেছে,মা একটা প্লেটে এক টুকরো কেক রিয়ার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে তার মাথার মুকুট টা ঠিক করে দিচ্ছিলেন,হঠাৎ যেন চারপাশটা দুলে উঠল রিয়ার।একটা পর্দা যেন চোখের সামনে থেকে সরে গেল,রিয়া যেন দেখতে পারছে যে সে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল রাজপ্রাসাদ এর ভিতর, সামনে প্রশস্ত অলিন্দ। অলিন্দে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি মেয়ে। বাইরে রুক্ষ পাহাড়ি পরিবেশ, অস্ত বেলার সূর্যের লাল আলোয় মেয়েটির শরীরের বহুমূল্য জরির কাজ করা শাড়ি ঝলমল করছে, আলো ছলকে পড়ছে তার শরীরের স্বর্ণা ভূষণ থেকে। হঠাৎ মেয়েটি পেছন ফিরে তাকাল, বোধহয় কিছু শুনে… কিন্তু মেয়েটির মুখ দেখে রিয়া হতভম্ব হয়ে গেলো।একি এ যে রিয়া নিজেই!!! এত মুখের মিল যে সে অবাক না হয়ে পারলো না। অলিন্দে আবির্ভাব হয়েছে আরও একটি মহিলার। পরণের বেশভূষায় মনে হয় পরিচারিকা স্থানীয় কেউ হবে । নতমুখে,করজোড়ে সে বলল,”মহারানী মহারাজ একবার আপনাকে স্মরণ করেছেন।” মহারানী !!!একি দেখছি রিয়া… সে নিজেকে মহারানী রূপে দেখছে।কিন্তু কোথায় দাঁড়িয়ে আছে সে? রিয়ার যেন মনে হল একটা ত্রিমাত্রিক সিনেমা হলে সিনেমা দেখছে,যেখানে দর্শক তথা কুশীলব সে নিজেই।মহারানী হাত বাড়িয়ে ইশারায় দাসীকে চলে যেতে বলে নিজের বেশভূষা আরেকবার ঠিক করে নিয়ে অগ্রসর হলেন।মহারানীর সাথে মন্ত্রমুগ্ধের মত যেন রিয়ার স্বত্বাও তার পিছু নিল।বিশাল বড় মহল,চারপাশে কারুকার্য করা অলিন্দগুলো পেরিয়ে আরেক বড় মহলে উপস্থিত হলো। এখানে বহু দূর থেকে শোনা যাচ্ছে সমুদ্রের আওয়াজ, এই আওয়াজই তার শরীরে এক অদ্ভুত অনুভুতির সৃষ্টি করে,যেন কে তাকে পরম ভালোবাসায় নিয়ে যেতে চায়।

মহারানীর উপস্থিতি অনুভব করে ঘরের মাঝখানে দন্ডায়মান রাজবেশ পরিহিত সুদর্শন পুরুষ টি ঘুরে দাঁড়িয়ে সহাস্য মুখে বললেন,” এসো বিষ্ণুপ্রিয়া আমি তোমারি অপেক্ষা করছিলাম”। কিন্তু ওকি!! বিষ্ণুপ্রিয়ার মুখটি ঐরকম ঘৃণায় বেঁকে গেল কেন রাজার আহবানে ?পরক্ষনেই মুখটি স্বাভাবিক করে বিষ্ণুপ্রিয়া বললেন,” বলুন মহারাজ কি জন্য ডেকেছিলেন”। মহারাজ তেমনই সহাস্য মুখে বললেন,” সম্রাট নরসিংহ বর্মন এর আদেশ এসেছে আমাদের রাজ্যে একটি রথ নির্মাণ হবে”। রানি বিষ্ণুপ্রিয়া অস্পষ্ট স্বরে বললেন,”রথ নির্মাণ হবে সে তো ভালো কথা কিন্তু আপনি যে বল দেবকে ধরে রেখেছেন, ওকে ছাড়া কি করে রথ নির্মাণ হবে?” মহারাজের মুখটি প্রচন্ড ক্রোধে নীল হয়ে গেল, পরক্ষণেই নিজেকে স্বাভাবিক করে বললেন,” বলদেব কে ছাড়তে তো হবেই, ওকে ছাড়া হলুদ পাথরের রথ কে নির্মাণ করবে? প্রথম মন্দিরটি দ্রৌপদীর রথ হিসেবে নির্মিত হবে আর সেটি মা দুর্গা কে নিবেদন করা হবে। কিন্তু বলদেবকে আমি শুধু সেই অব্দি সুযোগ দেব, যতদিন না রথরূপী মন্দিরগুলি শেষ হচ্ছে।”এবার বিষ্ণুপ্রিয়া একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, আর সেটি মহারাজের দৃষ্টি এড়ালো না। মহারাজের মুখেও ক্রুর হাসি খেলে গেল।বিষ্ণুপ্রিয়া বললেন,”তো আপনি কি আমায় এটা বলার জন্য ডেকেছিলেন?”মহারাজ আগের মতোই মুখে হাসি এনে বললেন,”না শুধু এটা নয়,আজ থেকে পনেরো দিন পর রথ নির্মাণ কাজ শুরু হবে।আর আমি আজই বলদেব কে ছেড়ে দিতে চাই, কারণ ওর তত্ত্বাবধানে কয়েকজন শিল্পীকে আমি রাখতে চাই যারা বলদেবের সাথে থেকে ওর মতো কাজ শিখে ওকে যোগ্য সঙ্গত দেবে।” মহারানীএই কথা শুনে কিছুটা আনন্দিত হলেও মুখে সে ভাব প্রকাশ করতে না দিয়ে বললেন,” এ তো খুব ভালো খবর।” মহারাজ হেসে বললেন,”হ্যাঁ,খুব ভালো খবর,আর সেই দশজন শিল্পী কে আমি আজ থেকেই কাজে লাগিয়ে দিচ্ছি ।”

বিষ্ঞুপ্রিয়া মহারাজের দিকে তাকিয়ে বললেন,” কিন্তু আপনি আমাকে কি জন্য ডেকেছিলেন?”

-“তুমি রাজরানী…তোমাকে খবরটা না জানালে কি করে হবে? মন্দির নির্মাণ হবার পর  এর উদ্বোধন তো তোমার হাতেই হবে।”মহারাজ সহাস্যে বললেন।

বিষ্ণুপ্রিয়া মহারাজের হাসি দেখে বুঝল শুধু এই কারণে মহারাজ তাকে এই খবরটি শোনান নি,এর পেছনে আরো অনেক কারণ আছে।

সজোরে গাড়িটি ব্রেক কষাতে রিয়া আচম্বিতে ফিরে এলো বর্তমান জগতে। রিয়া সামনের সীটে বসা তাজাহুদ দিকে তাকিয়ে বলল,”কি হলো সুব্রতদা আমরা এসে পড়েছি?” সুব্রত হেসে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন,”না, আর কিছুক্ষণ।” রিয়া মুখে কিছু না বলে স্মিত হাসলো। সেদিন তার জন্মদিনের রাতে হঠাৎ করে সে যে এতগুলো ঘটনা দেখতে পেয়েছিল তাতে সে সত্যিই স্তম্ভিত হয়ে গেছিল। কেন বারবার তার সাথে এগুলো ঘটছে সেটা জানার জন্য তার কৌতূহল ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল। সেদিন সে কোনমতে কেক কেটে অল্প কিছু মুখে দিয়ে বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে ইন্টারনেট খুলে বসে ছিল। বিভিন্ন জায়গা দেখতে দেখতে  সে দেখতে পেল ভারতের  দক্ষিণের এই শহরটিকে। তখনই সে ঠিক করে নিল তাকে যেতেই হবে একবার ওখানে। জানতে চায় কেন এসব হচ্ছে তার সাথে।

পন্ডিচেরীতে তার মাসতুতো দিদি থাকে। বছর তিনেক আগে সে বিবাহ সূত্রে ওখানের বাসিন্দা। প্রথমে রিয়ার মা-বাবা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না যেতে দিতে।তারপর দিদি মধুছন্দা সাথে কথা হবার পর তাঁরা রাজি হন।  গাড়ির গতি আস্তে আস্তে কমে আসছে দেখে  সে বুঝতে পারলো তারা গন্তব্য স্থানে পৌঁছাতে চলেছে। গাড়ি থেকে নামার আগে সে সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বলল,”সুব্রত দা আমি কিন্তু কালই ওই জায়গায় যেতে চাই”।

সন্ধ্যা অনেকক্ষণ হয়ে গেছে,হঠাৎ করে আকাশে মেঘ আসার জন্য আরো তাড়াতাড়ি আঁধার নেমে এসেছে।দিদির বাড়ির ব্যালকনি থেকে শহর টা অনেক দূর অবধি দেখা যায়। চেয়ারটায় চুপ করে বসেছিল রিয়া, প্রথম বার দিদির কাছে আসার জন্য বলাবাহুল্য দিদি খুবই খুশি হয়েছে। তবে মধুছন্দা যখন রিয়াকে বারবার জিজ্ঞেস করছিল,” তুই কেন যেতে চাস মহাবলীপুরাম সেটা তো আমাকে জানালি না।” তখন সত্যিই রিয়ার কাছে কোনো উত্তর ছিল না। সেতো নিজেই জানেনা কেন সে যেতে চায়। কিন্তু মনে হচ্ছে সে ওখানে গেলে তার মনের সমস্ত ধোঁয়াশা কেটে যাবে।

চেন্নাই থেকে ৫৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সপ্ত প্যাগোডার শহর মহাবলীপুরাম।পাহাড় কেটে নির্মিত ১০টি  গুহা মন্দির ষ,৯টি মনোলিথিক একশিলা  রথ মহাবলীপুরমের প্রধান আকর্ষণ হলেও এখানে সমুদ্র সৈকতের আকর্ষণ অস্বীকার করার উপায় নেই। পল্লব রাজ দ্বিতীয় নরসিংহ বর্মন এর দ্বারা নির্মিত শোর টেম্পলের  কাছেই আছে মহাবলীপুরমের মনোরম সাগরবেলা।নীল সমুদ্রের ফেনিল  তরঙ্গ আছড়ে পড়ে শোর টেম্পলের গায়ে। সেই তরঙ্গের আওয়াজ যেন সবসময়ে রিয়ার কানে বাজতে থাকে।

হঠাৎ করে চারিদিকটা যেন আরো বেশি করে অন্ধকার মনে হল। একটা ঠান্ডা বাতাস তার চারপাশে ঘুরপাক খেতে লাগল। রিয়ার খুব শীত করতে লাগলো। মনের মধ্যে একটা অজানা ভয় পাক দিয়ে উঠলো। চেয়ার থেকে উঠে আসতে গিয়ে হঠাৎ করে মনে হল কেউ তাকে যেন ঠেলে আবার চেয়ারে বসিয়ে দিল। রিয়া চমকে উঠে চারিদিকটা দেখল,না কেউ তো নেই হয়তো তার মনের ভুল।কিন্তু চারিদিকটা এত জমাট অন্ধকার কেন হয়ে গেল? জমাট অন্ধকার ভেদ করে সামনের দিক থেকে খুটখুট করে একটা আওয়াজ  ভেসে আসতে লাগলো… আওয়াজ এর উৎস সন্ধানের জন্য তাকাতে গিয়ে দেখল, কোথায় আঁধার…এ তো পার্বত্য ময়  উপত্যকা,জায়গাটা খানিকটা টেবিল ল্যান্ড এর মত…চারি দিকে ঢালু হয়ে নেমে এসেছে।আকাশে গোল থালার মত চাঁদ উঠেছে,তার আলোয় চারিদিকে ভেসে যাচ্ছে। সেখানে এক শিল্পী নিজের মনে পাথরের উপর ছেনি হাতুড়ি দিয়ে কাজ করে চলেছে। শিল্পীর কালো সুঠাম দেহের প্রতিটি পেশী,ছেনি হাতুড়ির প্রতিটি আঘাতের সাথে তাল মিলিয়ে সৃষ্ট করে চলেছে অভূতপূর্ব শিল্প। রিয়া সেই অপূর্ব রূপের দিকে তাকিয়ে কেমন মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। সেদিকে এগোতে যাবে এমন সময় উল্টোদিক দিয়ে তার জন্মদিনের দিন রাতে দেখা মহারানী বিষ্ণুপ্রিয়াকে আসতে দেখতে পেল ।

মহারানী কে দেখে সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়ালো শিল্পী। রানী ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললেন,” ও কি বলদেব…উঠে দাঁড়ালেন কেন?আপনি কাজ করুন,আমি তো আপনার কাজ দেখতে এসেছি।”বলদেব স্মিত হেসে মহারানীর দিকে তাকিয়ে বললেন,”সেতো আমার পরম সৌভাগ্য যে আপনি আমার কাজ দেখতে প্রায় আসেন।’ মহারানী স্মিত হেসে পাশের পাথর টার উপর বসলেন। তারা দুজনে কেউই লক্ষ্য করল না যে আড়াল থেকে একজন এই দৃশ্য দেখে নিঃশব্দে সরে গেল। সারা উপত্যকা চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে… এক শিল্পী আপন মনে তার কাজে ব্যাস্ত আর অন্যজন মুগ্ধ দর্শক… একাগ্রমনে সেই কাজ দেখতে বিভোর।হঠাৎ চারদিক থেকে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ ভেসে এলো, সৈন্য সামন্তসহ রাজা শম্ভু রাজ উপস্থিত হলেন সেখানে। আর এসেই সোজা তলোয়ার চেপে ধরলেন বলদেবের গলায়।রানী বিষ্ণুপ্রিয়া ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে বললেন,” মহারাজ একি আচরন আপনার”? মহারাজ শম্ভু রাজ কোন উত্তর না দিয়ে এক দাসি কে ইশারা করে মহারানী কে নিয়ে যেতে বললেন।যাবার আগে মহারানী শুনতে পেলেন যে মহারাজ আদেশ দিচ্ছেন সৈন্যদের যে বলদেব কে যেন কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। সিনেমার দৃশ্যের মতো পরপর ঘটনাগুলো রিয়ার চোখের সামনে ঘটে গেলো।মহারানীর সজল চোখ দুটি কখন যেন রিয়ার সজল চোখে পরিণত হয়েছে।

বহুদূর থেকে ভেসে আসতে লাগল রিয়ার নাম, রিয়া কিছুক্ষন পর বুঝতে পারলো যে তাকে দিদি ডাকছে। চমকে উঠে দিদি কে সাড়া দিল। মধুছন্দা জিজ্ঞেস করলেন তাকে,”কিরে রিয়া কখন থেকে ডাকছি তোকে, ঘুমিয়ে পড়েছিলি?”

-“না না দিদি, তুমি বলো কি বলবে।” অপ্রস্তুত হাসি হেসে বললো রিয়া।

-“আচ্ছা একটা কথা বলতো তুই কালকে মহাবলী পুরম যেতে চাইছিস কেন?”

রিয়া একটু হেসে বলল,”দিদি কিছুদিন ধরে আমার স্বপ্নে যেসব মন্দির, মূর্তি ভেসে আসছে সেগুলো ইন্টারনেটে সার্চ করে দেখতে পেলাম যে সেই অপরূপ দৃশ্যাবলী মহাবলিপুরম ই আছে।” মধুছন্দা একটু হেসে বললেন,”হ্যাঁ রে ওই অপরূপ সৌন্দর্যের সৃষ্টি পল্লব রাজবংশের আমলে হয়েছিল। একটু পরে আমি ডিনার দিয়ে দেবো, খেয়ে শুয়ে পড়িস।”

রাত্রিবেলা ডিনার শেষে যখন ঘরে নিজের বিছানায় এলো তখন প্রায় ন’টা। রিয়া তার দিদি মধুছন্দাকে সব বললেও এটা বলেনি যে তার মহাবলী পুরম এ যাবার আরও একটা কারণ আছে, তাকে ওই রথ কি ভীষনভাবে টানে। প্রথম রথ,অর্থাৎ দ্রৌপদীর রথে কিছু একটা আছে,যা তাকে বারবার স্মরণ করাচ্ছে যে তার ওখানে যাওয়াটা দরকার। একবার গিয়ে দেখতে চায় তার জন্য ওখানে কি অপেক্ষা করে আছে। লাইট অফ করে রিয়া শুয়ে পরার কিছুক্ষণ পর গলার উপর প্রচন্ড চাপ অনুভব করলো। ঘুম ভেঙে গেল সেই অসহ্য ব্যথায়!!! চোখটা খুলতেই ভয়ে-আতঙ্কে আঁতকে উঠল সে।একটা নিষ্প্রভ সাদা দৃষ্টি… ঠোঁটের কষ বেয়ে লাল রক্ত পড়ছে,হিস্ হিস্ কন্ঠে বললো,” তুই আবার বল দেবের কাছে যেতে চাস।”প্রাণপণে চিৎকার করতে চেষ্টা করলো কিন্তু গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হলো না রিয়ার। হঠাৎ ঘরের মধ্যে এক উজ্জ্বল নীল আলোর উপস্থিতিতে রিয়া চোখ বন্ধ করে ফেলল, তার গলার চাপটাও ধীরে ধীরে কমে যেতে লাগলো। চোখটা ভয় ভয়ে খুলে দেখল,না ঘরে তো কেউ নেই তাহলে কি ও স্বপ্ন দেখছিল?কিন্তু গলার ব্যথা টা যে তার এখনো আছে। কে ওই লোকটা আর বল দেবের সাথে তার কি সম্পর্ক? চকিতে তার মনে হলো যে বল দেবের সাথে রানী বিষ্ণুপ্রিয়ার কি সম্পর্ক সেটা যদি জানা যেত তাহলে হয়তো অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলত।কিন্তু সে তো নিরুপায়। রিয়া একটু জল খেয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করতে লাগল।

মহারানি … মহারানি…কে যেন ডেকেই চলেছে একটানা একঘেয়ে সুরে। রিয়া নয় রিয়ার আরেক সত্তা জেগে বসলো সেই ডাকে। সেই মহল, সেই রাজকীয় পোশাক আর বিছানা।ওই অলিন্দ থেকে আওয়াজটা আসছে না…বিষ্ণুপ্রিয়া গায়ের ওড়না টি ভালো করে জড়িয়ে ঘরের প্রদীপ টা উস্কে দিয়ে অলিন্দের কাছে গেলেন, দেখলেন আধো অন্ধকারে  প্রায় মিশে যাওয়া ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে। বিষ্ণুপ্রিয়া বললেন, কে আপনি আর প্রহরীরা কোথায় ? ছায়ামূর্তিটি যেন বিষন্ন হেসে বলল,”প্রহরীরা কেউ আমায় দেখিনি, আমি বলদেব”। রানী বিষ্ণুপ্রিয়া চমকে উঠে বললেন,” সে কি আপনি এখানে কিভাবে?আপনি তো কারাগারে…” কথা শেষ হবার আগেই বলদেব বললেন,”মহারানী আমার হাতে বেশি সময় নেই আপনি গজলক্ষ্মীর মন্দিরে একবার যাবেন, সেখানে বেদির তলায় আপনার জন্য একটা জিনিস রাখা আছে।”  রানী প্রথমে কিছুটা আশ্চর্য হলেও তারপর কৌতুকে সুরে বললেন,”আচ্ছা ঠিক আছে”। বলদেব রূপী ছায়ামূর্তিটি যেন কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে বলল,আমি এবার যাই।মহারানী সম্মতি দেওয়ার জন্য ঘাড় ঘোরাতে গিয়ে দেখলেন, বাইরের হাওয়ায় পর্দার কাপড় টা দুলে উঠলো শুধু আর কেউ নেই।রানী বিষ্ণুপ্রিয়া এবার অত্যন্ত কৌতুহল হতে লাগল বলদেব কি রেখেছে ওর জন্য। শিল্পকলা সর্বোপরি মানুষটির সরল ব্যবহার তাঁকে অত্যন্ত মুগ্ধ করেছে। যত মহারাজের ভিতরের শয়তানের সন্ধান পেয়েছে,অত্যাচারিত হতে দেখেছে সাধারণ মানুষদের,তত তার মায়া মমতা দ্বিগুণ হয়েছে সেই মানুষ গুলোর প্রতি।  শিল্পী বলদেব মানুষটির কাজের প্রতি মুগ্ধতা মহারাজের চোখ এড়াইনি। কিন্তু রানীর এই মুগ্ধতা কে মহারাজ স্হূল দৃষ্টিতে দেখে সেইরকম ই চিন্তা করেছেন।এই তো  সেদিন যখন তিনি বলদেবের বাম ভ্রু তে কাটা দাগ দেখে কারণ  জিজ্ঞেস করাতে শিশুর মত সরল হেসে বলেছিল,গাছে উঠতে গিয়ে পড়ে গেছিল। কি সুন্দর,সহজ-সরল হাসি! কোন মলিনতা,কোন অহংকার নেই সেই হাসিতে। সেই সরল হাসির ছোঁয়া তাঁর ও অন্তরে লেগেছিল। তিনিও হেসে উঠেছিলেন। কিন্তু এরপরের পরিণতি যে  এত ভয়ঙ্কর হবে তা তিনি বুঝতেই পারেন নি।  তবে বলদেবের কথায়  এভাবে তাঁর যাওয়াটা কি ঠিক হবে? রাজপ্রাসাদের প্রহরীরা যদি দেখতে পেয়ে মহারাজকে খবর দেয় তাহলে কি হবে?কয়েকপা পিছিয়ে গেলেন, কিন্তু ওই চোখদুটো যে  ব্যথিত হবে তিনি না গেলে… না, তাঁকে যেতেই হবে।

পশমের মোটা চাদর টা ভালো করে গায়ে মাথায় জড়িয়ে গজলক্ষ্মীর মন্দির এর দিকে রওনা দিলেন। মহারানী খাস পরিচারিকা তার সাথে আসতে চাইলেও তিনি মানা করে দিলেন। আকাশে একফালি চাঁদ উঠেছে বাইরে সমুদ্রের গর্জন,বালু প্রান্তরে হালকা চাঁদের আলো পড়ে পরিবেশটা আরো  মুগ্ধকর হয়ে উঠেছে। ধীরপায়ে মহারানী সেই মন্দিরে গিয়ে উপস্থিত হলেন। মন্দিরের চারপাশটা আধো অন্ধকার থাকলেও মন্দিরের গর্ভগৃহ প্রদীপের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে । গজলক্ষী ছাড়াও এই মন্দিরে মহা শিবের মূর্তি আছেন,যিনি মা গঙ্গা কে তার কোলে ধারণ করেছেন।গজলক্ষী কে প্রণাম করে বেদিতে হাত দিয়ে মহারানী দেখলেন বেদির নিচে পাথরের তৈরি দুই আঙ্গুল সমান একটা ছোট্ট মূর্তি রাখা রয়েছে। প্রদীপের আলোয় মূর্তিটাকে ভালো করে দেখতে গিয়ে ভারী আশ্চর্য হলেন আরে এ তো কোন দেবী মূর্তি নয় ,এ যে এক নারীর মূর্তি। মহারানী ততোধিক আশ্চর্য হয়ে দেখলেন এই যে তাঁরই মূর্তি!!! এইটুকু উচ্চতা কত সুন্দর করে তার সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে।রানীর চোখে জল চলে এলো। এত সুন্দর উপহার তিনি যে আর কোনদিন পাননি।

হঠাৎ মন্দিরের দরজার কাছে এক ছায়ামূর্তির আবির্ভাব হলো,তার হাতে উদ্যত তলোয়ার।রানী শংকিত হয়ে প্রহরীদের উদ্দেশ্যে ডাক দিলেন। ছায়ামূর্তিটি অট্টহাস্য করে এগিয়ে এলো… মহারানী আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলেন… এ যে অন্য কেউ নয় মহারাজ শম্ভুনাথ। হাতে উদ্যত তলোয়ার যার শাণিত ফলা টি রক্তে রাঙা,টপ টপ করে এখনো রক্ত ঝরছে… মহারানী শঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,”একি মহারাজ আপনি কাকে হত্যা করেছেন?” মহারাজ সে কথায় কর্ণপাত না করে মহারানীর হাত থেকে মূর্তিটি ছিনিয়ে নিয়ে বললেন, “এটা বলদেব তোমায় দিয়েছে তাই তো? এত সাহস ওর হয় কি করে? ওর রক্ত দিয়ে আজ আমি গজলক্ষী কে স্নান করাবো।  আমি হত্যা করেছি আমি বলদেবকে।” মহারানী আর শুনতে পারলেন না। তিনি চিৎকার করে মাথা চেপে ধরে চেপে ধরে বসে পড়লেন শিব ঠাকুরের পায়ের তলায়।

মহারাজ শম্ভুনাথের মহারানীর এই অবস্থা দেখে বিন্দুমাত্র দয়ার  উদ্রেক হলো না। বাইরে দন্ডায়মান প্রহরীর উদ্দেশ্যে হাঁক  দিতেই প্রহরী এসে মহারাজের হাতে কিছু একটা দিতেই তিনি সেটা ছুঁড়ে মহারানীর কোলেতে ফেললেন। রানী বিষ্ণুপ্রিয়া চমকে উঠলেন এবং তারপর আতঙ্কে ভয়ে চিৎকার করা শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেললেন। এ যে  বলদেবের মস্তক !!! ভয়ে,দুঃখে, ঘৃণায় তিনি থর থর করে কাঁপতে লাগলেন।তখনো মহারাজ নৃশংসভাবে অট্টহাস্য করে চলেছেন। মহারানী চিৎকার করে বললেন, “চুপ করুন মহারাজ আর এভাবে নিজের পাপ বাড়াবেন না।আপনি আমায় শুধু এই মূর্তিটি দিয়ে দিন।”

মহারাজ হিংস্রভাবে তার দিকে তাকিয়ে তরবারিটি  গলার কাছে ধরে বললেন,”লজ্জা করে না তোমার? এখনো তুমি এই মূর্তিটা চাইছো আমার কাছ থেকে? দেখো এখনো এতে বলদেবের রক্ত লেগে আছে আর এই তরবারি দিয়েই আজ তোমাকেও শেষ করবো।”

রাণী বিষ্ণুপ্রিয়া কিছু না বলে শুধু চোখের জল ফেলে বললেন ,”তাই করুন মহারাজ এতেই আমার পরম শান্তি।তবে এটুকু আমি আপনাকে বলি আমি কোনো অন্যায় বা পাপ করিনি। আপনি একজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করলেন বিনা কারণে।”  মহারাজ শম্ভুনাথ তাঁর হাতের তরোয়ালটি  তুলে ধরলেন মহারানী কে হত্যা করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু তাঁর উদ্যত তরোয়াল হাতেই রয়ে গেল। হঠাৎ সারা ঘরময় এক নীলাভ আলোয় ভরে গেল,ওই আলোটি এক জায়গায় জড়ো হয়ে এক মানুষের আকার নিল, মহারাজ  ভয়ে বিস্ময়ে ওই ছায়া মানুষ টার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ছায়া মানুষটি ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। ছায়া মূর্তিটির হাত ধীরে ধীরে উঁচু হয়ে উঠল, তরবারিটি হঠাৎ দিক পরিবর্তন করে মহারাজের গলার দিকে ঘুরে গেল… মহারাজ ভয়ে পালাতে গেলে তরবারি টি সজোরে চেপে বসলো তার গলায় ! ছিন্ন মস্তক লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে। মহারানী এবার ভয়ে কেঁদে উঠলেন। ছায়ামূর্তিটি ধীরে ধীরে তার কাছে এসে বলল,” পাথরের মূর্তিটি রথের তলায় থাকবে”।

ঘড়ির এলার্ম এর শব্দে ঘুম ভেঙে গেল রিয়ার… দরদর করে সারা শরীর তার ঘামছে! পেয়েছে সে সব প্রশ্নের উত্তর  পেয়েছে। এতদিন ধরে সে যে  স্বপ্ন দেখতো  তার মধ্যে খুঁজে চলা সমস্ত প্রশ্নের উত্তর আজ সে পেয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি করে উঠে তৈরি হয়ে নিল।

দিদি জামাইবাবুর সাথে যখন সে মহাবলিপুরম পৌঁছাল তখন সূর্য মাথার উপর। বঙ্গোপসাগরের নীল জলের অবিরাম আসা-যাওয়া।কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে ঝাউবনে বাতাসের শব্দ।সমুদ্রের গর্জন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। বিস্তীর্ণ বালুকাবেলায় জেগে থাকা অনবদ্য কিছু প্রস্তর ভাস্কর্য। অনন্ত সলিল আর গৌরবময় অতীতের এক নিবিড় সম্পর্ক। আছড়ে পড়া ঢেউয়ের বুকে কান পাতলে শোনা যায় প্রবল পরাক্রমশালী রাজা- রাজড়াদের কীর্তি কাহিনী। অজস্র নাম না জানা শিল্পীর কঠিন অধ্যবসায়,আত্মত্যাগের গল্পগাথা। ভগবান বিষ্ণু বামনাবতার রূপে মহাবলী অসুরকে বধ করেন। সেই অসুরের নামেই স্হানটির নাম। রিয়া অবাক হয়ে দেখছিল এই অপূর্ব ভাস্কর্য। সুব্রত তার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,”এই মন্দিরগুলো গড়ে ওঠার পিছনের ইতিহাস শুনবে?” রিয়া ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলতে ওরা গিয়ে বসলো এক মন্দিরের চাতালে। তারপর সুব্রত শুরু করলো…

“বঙ্গোপসাগরের বালুকাবেলায় খ্রিস্ট্রীয় সপ্তম শতকে আস্ত পাহাড় কেটে তৈরি হয়েছিল এখানকার মন্দিরগুলো। প্রকৃতির রোষানলে পড়ে ইতিমধ্যেই লুপ্ত হয়েছে এখানকার বেশ কয়েকটি মন্দির। ছোট ছোট পাথরের টিলা কেটে তৈরি হয়েছে পঞ্চরথ। এখানে নয়টি রথ থাকলেও পাশাপাশি রয়েছে পাঁচটি। এরা পঞ্চপাণ্ডব নামেই পরিচিত। আছে দ্রৌপদীর নামেও রথ। অনেকটা বাংলার চালারীতিতে তৈরি ছোট্ট রথের ভেতরে রয়েছেন চতুর্ভুজা দেবী দুর্গা। এটিই দ্রৌপদীর রথ। এর সামনে একটু বড়, ধাপে ধাপে উপরে ওঠা মন্দিরটি অর্জুনের। খুব সুন্দর এই মন্দিরের গায়ের প্যানেলগুলোতে রয়েছে দ্বারপাল, শিব, দেবরাজ ইন্দ্র ও বিষ্ণুর মূর্তি। মহাবলী ভীমের রথটি বেশ বড় এবং আয়তকার দোচালা ঘরের মতো। এতে অন্যান্য মন্দিরের মতোই রয়েছে নকল দালান, চাতাল ইত্যাদি। মন্দিরের গায়েও রয়েছে অজস্র দেবদেবীর মূর্তির সমাহার। এই পঞ্চরথের মধ্যে সবচেয়ে বড়টি স্বয়ং ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের। আকৃতিতে খানিকটা পিরামিডের মতো কিছুটা অর্জুনের রথের মতো দেখতে হলে তুলনায় অনেক বৃহদাকারের। বর্গাকার ভূমি থেকে ধাপে ধাপে উঠেছে উপরের দিকে। দেয়ালের প্যানেলে দেখা যায় চতুর্ভুজ মহাদেব। আছেন ব্রহ্মা, কার্তিক এবং হরিহরও। পল্লবরাজ নরসিংহবর্মনের একটি মূর্তিও রয়েছে এখানে। প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের অসামান্য এক নিদর্শনস্বরূপ এখানে দেখা যাবে একটি অর্ধনারীশ্বর মূর্তিও, যেন একই অঙ্গে হর-পাবর্তী, সৃষ্টি ও ধ্বংসের এক অপরূপ মেলবন্ধন। এখানকার দেয়ালে খোদিত আছেন শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী বিষ্ণু; আছে পুরাণের নানা উপকথা – কৃষ্ণের কালীয়দমন। পাশেই নকুল-সহদেবের রথ। আকৃতিতে ছোট হলেও মন্দির গাত্রের অলংকরণের বিষয়ে মোটেও পিছিয়ে নেই। রথের সামনে বৃহদাকারের এক হস্তিমূর্তির উপস্থিতি গোটা পরিবেশে এনে দিয়ে এক গাম্ভীর্যময় অনুষঙ্গ। পঞ্চরথ ছাড়াও এখানে বহু শিল্পকীর্তি রয়েছে। সাগরবেলার ভুবনবিখ্যাত মন্দিরগুলো তৈরি হয় সপ্তম শতাব্দীতে পল্লবরাজ নরসিংহবর্মনের আমলে। বেশ কয়েকটি মন্দির চলে গিয়েছে সাগরের গ্রাসে। সাগর সৈকতের এই মন্দিরগুলো সৈকত মন্দির নামেই পরিচিত। দ্রাবিড়ীয় রীতিতে তৈরি মন্দির দুটি পাঁচতলা, পিরামিডের মতো ধাপে ধাপে উঠে গিয়েছে। দীর্ঘকাল বালির নিচে চাপা পড়ে থাকার পর ১৯৪৫ সালে বালি সরিয়ে উদ্ধার করা হয়েছে। একটি মন্দিরে রয়েছে শিব, অন্যটিতে অনন্তনাগের শয্যায় শায়িত ভগবান বিষ্ণু। এই অবাক করা মূর্তিটি দেখলে মনে হয়, সময় যেন থমকে গিয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় ভাস্কর্যশিল্পের খনি এই মহাবলীপুরমে রয়েছে বহু কিছু, যার অন্যতম হলো বারোটি গুহামন্দির বা মণ্ডপ। এখানকার বিখ্যাততম ভাস্কর্য অর্জুনের তপস্যা। পাহাড়ের গায়ে ব্যাস-রিলিফের কাজ। অজস্র মূর্তির মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে পাশুপাত অস্ত্রের জন্য তপস্যারত অর্জুনের কাহিনী। ৯০ ফুট লম্বা এই ভাস্কর্যটিতে রয়েছে অজস্র মূর্তি। দেখানো হয়েছে গঙ্গার মর্ত্যে আগমন। মহিষমর্দিনী মণ্ডপে আছে দেবী দুর্গার সাথে মহিষাসুরের যুদ্ধ। বরাহ মণ্ডপে দেখা যাবে বরাহ ও বামন অবতারের রূপধারী বিষ্ণুকে। কৃষ্ণ মণ্ডপে দেখানো হয়েছে শ্রীকৃষ্ণের জীবনের সুপরিচিত ঘটনাবলি। এখানকার গোবর্ধন ধারণের মূর্তিটি ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্য হিসেবে বিখ্যাত। ইতিহাস আর প্রকৃতির মধ্যে ঋদ্ধ মহাবলীপুরম নিঃসন্দেহে অতুলনীয়।” একসাথে  এতক্ষণ কথা বলে সুব্রত একটু হাঁপিয়ে গেছিল।জল খাবার জন্য  থামতেই রিয়া বললো,” এই ঘটনা ছাড়াও  আরো একটি  মর্মান্তিক ঘটনা আছে যা শুধু আমিই জানি। যা কোথাও লেখা নেই। চলো আমরা ওই পাঁচ রথের কাছে যাই।”

পাঁচ রথের কাছে গিয়ে প্রথম রথটির সামনে একটা জায়গা দেখিয়ে জামাইবাবু কে বলল,এই জায়গাটা খুঁড়তে হবে। দিদি জিজ্ঞেস করল,’ কেন এখানে খুঁড়ে কি হবে?’ রিয়া কিছু না বলে দিদিকে চোখের ইশারায় বললো, দেখো  না কি হয়? সুব্রত তার সঙ্গের লোকটিকে নির্দেশ দিল খোঁড়ার। বালি আর মাটি কিছুটা সরাতেই বেরিয়ে পড়ল সাত-আট ইঞ্চি মাপের একটি নারীমূর্তি…পোশাক সপ্তম শতাব্দীর হলেও মুখ টি অবিকল রিয়ার মত। আর তার শৈল্পিক গঠন অনবদ্য, অসাধারণ। বোঝাই যাচ্ছে কোন দক্ষ শিল্পীর হাতে আঁকা এক অপরূপ ভাস্কর্য।মধুছন্দা ও সুব্রত সেই সৃষ্টির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে  তাকিয়ে রইলো।রিয়া যখন সেই মূর্তিটি হাতের মধ্যে নিল তার সারা শরীরে এক অজানা শিহরন খেলে গেল। মনে হল বড় চেনা,বড় আপন এই মূর্তি এবং তার সৃষ্টিকর্তা।  এরই অপেক্ষায় সে বোধহয় এত দিন বসে ছিল। জামাইবাবু রিয়ার কাছে এসে তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,” রিয়া বাড়ি যাবে কি তুমি এখন?” একটু স্মিত হেসে দিদির দিকে তাকিয়ে রিয়া বললো, “দিদি এই মূর্তিটা এখানে আমি রাখলাম। একটু সমুদ্রের ধার থেকে ঘুরে আসছিআমি।”

মধুছন্দার অনুমতি ছিল না রিয়াকে একা যেতে দেবার। কিন্তু সুব্রত তার হাতটা চেপে ধরতেই  সে থেমে গেল। বুঝতে পারল রিয়াকে বোধহয় এখন একটু একা ছেড়ে দেয়াই ভালো।

সমুদ্রের ধারে গিয়ে কিছুক্ষণ রিয়া তাকিয়ে রইল অসীম জলরাশির দিকে। ঢেউয়ের গর্জন আর তার কানে পৌঁছাচ্ছে না। মনে হচ্ছে দূর থেকে  ছেনি হাতুড়ির শব্দ ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে কোন শিল্পী আপন-মনে খোদাই করে চলেছে পাথরের উপর তার শিল্প কার্য। সমুদ্রের জলে পা ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে কখন যে সে একটু ভেতর দিকে চলে গিয়েছিল বুঝতে পারেনি।হঠাৎ একটি বলিষ্ঠ, পুরুষালী হাতের টানে চমকে দেখে  এক সুদর্শন দীর্ঘকায় পুরুষ তার সামনে দাঁড়িয়ে। বলছে ,”আপনার মনটা কোন দিকে আছে আর একটু হলেই যে বিপদে পড়তেন”। বক্তার  দিকে চেয়ে রিয়া হতবাক। এ যে তার স্বপ্নে দেখা সেই শিল্পী, বলদেব। অবিকল তার মত দেখতে। বাম ভ্রু তে রয়েছে সেই কাটা দাগ। ছেলে মানুষের মতো উচ্ছল হয়ে উঠল রিয়া, মনে হল বহুপরিচিত মানুষটাকে সে খুঁজে পেয়েছে।বলল, তুমি কি সেই বলদেব?

ছেলেটি তার কাটা ভ্রূ তুলে তার দিকে  কৌতুহলী দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। বললো,” আমি তোমার সেই বলদেব কিনা জানিনা। তবে তোমার মতো সুন্দরীর যদি প্রিয় মানুষ হতে পারি তবে তো আমার পরম সৌভাগ্য।” রিয়ার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। সমুদ্রের গর্জন ছাপিয়ে তাদের আলাপচারিতা ততক্ষনে শুরু হয়ে গেছে। মহাবলী পুরম সাক্ষী থেকে গেল আর এক নতুন প্রেম কাহিনীর।

Leave a Reply

Your email address will not be published.