পুজো আসছে” — বাঙালি মনে খুশির দোলা দিতে ছোট্ট এই বাক্যটির জুড়ি মেলা ভার। চেনা বাক্যটিকে প্রতিবছরই নতুন মনে হয়। ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের দিনটিতে কে যেন আমায় ফিসফিস করে বলে, “পুজো আসছে”। চারিদিকে দেশাত্মবোধক গানের সুরে দেশমাতৃকাকে প্রণাম করার সময় চোখে ভেসে ওঠে আর এক মাতৃমুখ। আমার দুর্গামায়ের মুখ। একাধারে জননী ও কন্যার সাজে উমার আগমন বার্তা টের পাই। এবছরও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
সারাবছর ব্যস্ত থাকি নিজের কাজের জগতে। আমার কর্মদুনিয়াই আমার উৎসবের দুনিয়া। সুন্দরের পূজারী আমি। আর কে না জানে উৎসব মানেই সুন্দর। ১৪২৭-এ আমরা পুজোকে সংক্ষিপ্ত করতে বাধ্য হয়েছিলাম। এবছরও সংক্ষিপ্তই রাখব। হঠাৎ আসা বিপদ থেকে পরস্পরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই এই সংক্ষিপ্তকরণ। তবে সেসব বহিরঙ্গে। অন্তরে উৎসবের মেজাজের কোনও কমতি নেই আমাদের। সে মেজাজ এতটাই মজবুত যে প্রকৃতিও পারে না তাতে চিড় ধরাতে। পুজোর আগে মাঝে মাঝেই আজকাল ঝড় ধেয়ে আসে। কিন্তু পারে কি ঝাপটা দিয়ে একদম শেষ করে দিতে আমাদের? পারে না৷ আমরা মোকাবিলা করি মুখোমুখি হয়ে। সুন্দর সুন্দর নাম দিয়ে ঝড়েদের কাছেই রেখে দিই আমাদের ঠিকানা। জীবন জোয়ারে ভাসতে গেলে এভাবেই এগোতে হবে। মনে পড়ছে সেই ১৯৭৮ সালের পুজোর কথা। পুজোর আগেই রাজ্যজুড়ে বন্যা। আমার শহর কলকাতা ভাসল বন্যার জলে। সারারাত জুড়ে চলা টিপটিপ বৃষ্টি যে শহরকে বন্যায় ভাসাবে ভাবিনি। বাবা বলেছিল আকাশভাঙা বৃষ্টিতে বন্যা হয় না। টিপটিপ করে চলা একনাগাড়ের বৃষ্টি বন্যার জন্ম দেয়। তখন অনেক ছোট ছিলাম। সবাই বলছিল এবার পুজো হবে না। কত মানুষের ঘরদোর ভেসে গেছে। আনন্দ করবে কী করে মানুষ। ছোট মেয়ে আমার মন খারাপ হয়েছিল এমন কথায়। কিন্তু শেষ অবধি পুজো হয়েছিল। মোকাবিলা করেছিল রাজ্যবাসী সেই দুর্যোগের। উৎসবের স্পর্শ পেয়েছিল রাজ্যের আনাচ কানাচ৷
নিঃসন্দেহে কাজের দুনিয়াই আমার কাছে উৎসবের দুনিয়া। অদ্বিতীয়ার সম্পাদক, অ্যারোমাথেরাপিস্ট, ফ্যাশন ডিজাইনার, স্পা- ওনার, কেয়া শেঠ’স কলেজ অফ বিউটির প্রিন্সিপাল ইত্যাদি বিভিন্ন পরিচয়ে লোকে আমায় চেনেন। কিন্তু নিজের কাছে আমার পরিচয় আমি ‘একজন মানুষ’। এই মানুষ কেয়া শেঠ নিজের সঙ্গে নিজে উৎসব পালন করে ৷ সারাদিন নানা ঘটনার মুখোমুখি হই। এসবের মধ্যে কোনও কোনও ঘটনা আমার ভাবনার জগৎ তোলপাড় করে। সেই ভাবনাগুলোর সঙ্গে শুরু হয় আমার ওঠাবসা। যা আমার একান্ত উৎসব। এই উৎসব পালন করি কেয়ার ডায়েরি লিখে। ডায়েরির পাতায় পাতায় উঠে আসে ভাবনাগুলো। খুঁজে চলি সেসবের সদুত্তর। কখনও উত্তর পাই, কখনও পাই না।
এবারের দুর্গোৎসবের দোরগোড়ায় হঠাৎ করে আসা পরস্পর বিরোধী দুটো বিষয় বেশ ভাবাচ্ছে৷ আমি জানি আমার অন্যান্য যাবতীয় পরিচয়ের মধ্যে নিজের কাছে সবথেকে বড় পরিচয় হল আমি একজন “মা”। কথায় বলে, মা হওয়া কি মুখের কথা! সত্যিই তো প্রতিটি মা জানেন মা হওয়া মুখের কথা নয়। সন্তানের জন্ম দিয়েই মায়ের কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না। সেই সন্তানকে সুপথের দিশা দেখানো মায়ের কর্তব্য। সন্তান ভুলপথে পাড়ি দিলে সবথেকে কষ্ট পান সন্তানের মা এবং বাবা। সম্প্রতি এক বিখ্যাত তারকাপুত্রের ভুলপথে পাড়ি দেওয়া নিয়ে মিডিয়া আলোড়িত। বুঝতে পারছি এমন ঘটনায় মায়ের মনোবেদনা। তাই চাইব যত কাজই থাকুক না কেন প্রতিটি মা যেন সন্তানের মনে সঠিক দিশা বপন করতে পারেন। উৎসব তাহলে আরও আলোময় হয়ে উঠবে। দ্বিতীয় যে ঘটনাটি এবার আমার উৎসবকে অন্যান্যবারের থেকে আরও বেশি আলোময় করে তুলল সেটি হল কলকাতার এন আর এস হাসপাতালে দেশের প্রথম টেস্ট টিউব বেবির আবিষ্কারক ডক্টর সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠা। যদিও এই সম্মান পেতে আবিষ্কারকের তেতাল্লিশ বছর সময় লেগে গেল। অনেক বিতর্কের শিকার হয়েছেন তিনি নিজের জাতভাইদের কাছেই। আজ তিনি আমাদের মধ্যে নেই। তাই সেসব বিতর্কিত প্রসঙ্গে যেতে চাই না। একজন মা এবং বাবার মধ্যে সন্তান আকাঙ্ক্ষা যে কত তীব্র এবং সে আকাঙ্খা না মেটা যে কত বেদনার সেটি বুঝেছিলেন ডক্টর মুখোপাধ্যায়। তাই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন টেস্ট টিউব বেবির গবেষণায়। আবিষ্কার সফল হয়েছিল। জন্ম নিয়েছিল দুর্গা। ডাক্তারবাবু নিজেই কন্যাটির নামকরণ করেছিলেন। এবারের দুর্গোৎসবের প্রাক্কালে সেই দুর্গাই উন্মোচন করল তার আবিষ্কারকের মূর্তি। এর থেকে আনন্দের আর কী হতে পারে। দুর্গার মা বেলাদেবীর মুখে হাসি ফুটিয়েছিলেন ডক্টর সুভাষ মুখোপাধ্যায়। খুব সহজপথে সে হাসি আসেনি আমরা জানি। বেলাদেবী জানেন সন্তানের মূল্য কতখানি।
প্রথমোক্ত ঘটনাটির সন্তানকে তার মা খুব সহজেই পেয়েছিলেন। কাঠখড় পোড়াতে হয়নি বেলাদেবীর মতো৷ কিন্তু কাঠখড় পোড়াই আর না পোড়াই সন্তানকে সুপথ বাৎলানো প্রতিটি মা এবং বাবার প্রথম কাজ বলেই মনে করি। সন্তান সুসন্তান হলে তার থেকে বড় উৎসব মা, বাবার কাছে আর কী হতে পারে।