রূপমতী তিস্তার কোলে পেখম-মেলা লেপচাখা।। দিব্যেন্দু ঘোষ

শেষ বিকেলে দিগন্তের নাভিমূলে ভেসে বেড়াচ্ছে একমুঠো রং। সবুজের প্রাণ নিয়ে লোফালুফি খেলছে একবৃক্ষ প্রজাপতি। দারুচিনি দ্বীপ থেকে উঠে আসছে একবুক যৌবন-সুষমা। সূর্য নিভে গেলেও আগামিকালের প্রত্যাশা জিইয়ে রেখে ওরা কাজে নেমে পড়েছে। ওরা মানে সূর্যের উপাসনায় যাদের উত্সর্গ করা হয়েছে মাঙ্গলিক মন্ত্রের মোড়কে—‘বেশ্যাকমদম্বকং, যস্তু দস্যাত্‍ সূর্যায় ভক্তিতঃ’। যারা মন্দির প্রাঙ্গণে ভগবানের উপাসনার দুয়ার উন্মুক্ত করেছে। সমাজের প্রান্তবাসী এই নারীদের রূপ-যৌবন-শরীর-কলা-শিল্পকে উল্লসিত লোলুপ সমাজ শুধু ব্যবহারই করেছে। কিন্তু প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়নি। সামাজিক কাজকর্মে বারাঙ্গনা সমাজ অচ্ছুত্‍। অথচ গণিকালয়ের মাটি ছাড়া আরাধ্যা দেবী দুর্গার মূর্তি নাকি গড়া যায় না। এ কী প্রহসন! আজকের এই বিশ্বায়নের যুগে মতাদর্শগতভাবে সমাজ পরিবর্তনের ফলশ্রুতিতে যৌনতা সংক্রান্ত ভাবনায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। সমাজের প্রান্তিক এই নারীদের অনেকেই যৌনকর্মীর অভিধা পেতে চান। দারিদ্র্য, প্রতারণা কিংবা মাফিয়াচক্রের শিকার হয়ে যাঁরা অনিচ্ছায় যুক্ত এই বৃত্তিতে, তাঁরা মিলতে চান সমাজের মূল স্রোতে।

আমার ডায়েরির তেমনই কয়েকটা পাতা আলগোছে স্মৃতি আলস্যে চুবিয়ে রেখেছে একফালি বাসন্তিক প্রণয়। ডায়েরি মিথ্যে বলে না। কলম সত্যের অপলাপ করে না। আর সেই পাতাগুলি যদি ভরাট যৌবনের অভ্যেসে মিশে থাকা দিনলিপি হয়! যদি আরণ্যক উপলব্ধি অবিরাম জড়িয়ে থাকে। ডুয়ার্সের আলাপনে যদি নিত্য ভেসে বেড়ায় সবজেটে প্রেম! এক প্রেমিক পুরুষের পদচারণ যদি বাতাসে নেশার মতো মিশে থাকে। জঙ্গলে যদি জংলি প্রেম উথলেই না উঠল, তা হলে সে জঙ্গল বৃথা, সে পৌরুষ ব্যর্থ, সে প্রেম প্রেম নয়।

আমি কমার্স, অথচ মনের হিসেব বুঝি না। সাহিত্যের ছাত্র না হলেও কলমের কলকাকলি আমার অন্তরাত্মাকে উল্টে-পাল্টে সেঁকে নেয়। এমন প্রেম, এমন ছোঁয়া আজও শরীরে দগদগে। ভালবাসার এমন সুমধুর অত্যাচার অবিরাম শরীর-মনকে উত্তাপ দিয়েছে। উষ্ণ হয়েছে জঙ্গল-প্রীতি। ঘন অরণ্যের বুক চিরে পিচ-ঢালা কালো রাস্তারা কখন যেন আমার প্রেম-সরণি হয়ে পড়েছে। জঙ্গলের হোম-স্টের তেতলার বারান্দা যেমন সূর্যের নরম রোদে অভিসারী, তেমনই আমার ডায়েরি হয়ে উঠেছে ভবিষ্যতের প্রীতি-কাব্য। গদ্যের গহনে পদ্যের পাপড়ি মেলেছে আলতো প্রেমের নরম অভিধা।

সেই লাল পাড় সবুজ শাড়ি, সেই নীল ভেলভেটের টিপ। সেই কমলোষ্ণ ঠোঁট যুগল। সেই পান-পাতা কান-দুল। সেই পনিটেল। সেই ফরসা পিঠে ব্লাউজের গিঁট। সেই বাঁহাতের অনামিকায় সরু হিরের আংটি। সেই পূর্ণিমার উজ্জ্বল চাঁদের মতো গোল সুগভীর নাভি। সেই উরু, সেই নিতম্ব। ডান পায়ের গোড়ালিতে একফালি নূপুর। দুপায়ের দশ আঙু্লে মেপে কাটা নখে সেই সবুজ নেলপালিশ। খুঁটিয়ে না দেখলে কি বলা সহজ! সেই কত দূরে, ওপারের বারান্দায় এসে দাঁড়াত। সবুজ অরণ্য ভেদ করে দৃ্ষ্টি প্রসারিত হত। প্রমে পড়তে ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু বললেই কি প্রেমে পড়া যায়! আলাপের উপান্তে বুঝেছিলাম, ঠাঁই নরম, কিন্তু জেদ শক্ত। খুব কাছ থেকে চোখ আটকেছে ওই দুচোখের মণিতে। বুঝেছিলাম, ক্যাটস আই। ভ্রু-তে অদ্ভুত বসন্তের রং। চোখের পাতায় কালো রঙের আলতো আঁকিবুকি। খুব কাছ থেকে ঠোঁটে দেখেছিলাম মায়া। কিন্তু সে মায়া যেন বিন্যস্ত চতুষ্কোণে গড়া এক অপূর্ব খেলাঘর।

সেই খেলাঘরে যৌবনের জলছবি আঁকার সুযোগ মিলেছিল দুই রাত্রি তিন দিন। তার নাম পেখম। যিনি এই নাম রেখেছিলেন, তিনি যদি আজ দেখতেন। শরীর জুড়ে পেখম-মেলা ভোর। সূর্যের ঘন ও নিপাট রংবাহারি। বনাঞ্চলের আঁধার-ছেঁড়া রশ্মি। এ রূপ গড়তে যত্ন লাগে। নিজেকে ভালবাসতে হয়। কিন্তু সেই ভালবাসা যে অপরের হয়ে যাবে, সর্বজনের খেলার সামগ্রী হয়ে যাবে, মেয়েবেলা পেরিয়ে কিশোরী মন আন্দাজ করতে পারেনি। তারুণ্য আর যৌবনের চৌকাঠে যে ঘুণ ধরেছিল, তা বোঝার সময় মেলেনি। ঘর ও বাহিরে শ্বাপদের দল ঝাঁপিয়ে পড়েছে বার বার। জড়িয়ে ধরেছে অভিশাপ আর হিংস্রতা। বদলে দিয়েছে মন। এক সময় নিজেই বদলে নিতে চেয়েছে। তারপর প্রতিশোধের আগুন জ্বলেছে দাউ দাউ করে। সেই আগুন একটু একটু করে পোড়াতে চেয়েছে পুরুষ জাতটাকে। নিশানায় এক বা একাধিক পুরুষ নয়, বহু। যে শরীরটা একসময় ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়েছে প্রেমিক তথা স্বামী এবং তার বন্ধুরা, সেই শরীরকেই প্রতিশোধের হাতিয়ার করেছে পেখম। নিজে পুড়ে অন্যকে পুড়িয়েছে। রাতের পর রাত। টাকা, পার্টি, হোটেল, ট্যুর। রঙিন দুনিয়ায় নেশা  ধরিয়েছে। মুঠো মুঠো কাঁচা টাকা আর পৌরুষের অহঙ্কার খান খান করে পেখম তুলে নেচেছে পেখম। তারপর ঢকঢক করে গলায় ঢেলেছে জ্বলনের তরল। আবার একটা ভোর শুরু হয়েছে প্রতিশোধের আগুনে পেখম ডুবিয়ে। এইভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। দিন যত গড়িয়েছে, ততই দামি হয়েছে পেখম। এখন আর ছোটখাটো শিকার করে না। সবাই হাইপ্রোফাইল, সমাজের উঁচু মাথা, সম্মাননীয় বলে পরিচিত। মানে, গায়ে স্ট্যাম্প-মারা উচ্চশ্রেণি। রাত নামলেই পেখমের পায়ের তলায় হামাগুড়ি দেয় তারা। ওদের অহঙ্কার নিংড়ে নেয় পেখম। উচ্চশ্রণি থেকে তাদের পৌরুষের কলার ধরে কার্যত ঝুপড়ির এঁদো আঁধারে নামিয়ে আনে। সমাজ-শাসকরা ভিজে বেড়ালে পরিণত হয়। মজা পায় পেখম। পেখম তুলে নাচে।

এখন পেখমের এক রাতের পারিশ্রমিক পঞ্চাশ হাজারের কম নয়। সেই পেখমের পাখনায় রাত মাখার প্রারম্ভিক গল্পটা শুরু আমার ডুয়ার্স-ভাললাগা দিয়েই। বার বার গিয়েও পুরনো হয় না। বন্য প্রকৃতিকে নতুন করে খুঁজে পাওয়ার অবিরাম চেষ্টা চলে আমার মনের ভিতরে ও বাহিরে। তেমনই মনের অনেকটা কাছে থাকে লেপচাখা। প্রায় সাড়ে তিন হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত একটি পাহাড়ি গ্রাম। কখনও রোদ ঝলমলে দুপুরের আকাশে হঠাত্‍ই উড়ে আসে মেঘের চাদর, ক্ষণিকের জন্য ঢেকে দিয়ে যায় লেপচাখাকে। নিউ আলিপুরদুয়ার স্টেশন থেকে মাত্র ছাব্বিশ কিলোমিটার দূরে সান্তালাবাড়ি। স্টেশন থেকে গাড়ি। বক্সা দুর্গ পর্যন্ত যাওয়া যায়। তবে গাড়ি যায় ভিউ পয়েন্ট পর্যন্ত। তারপর তিন কিলোমিটার পাহাড়ি পথ। ইতিহাসের পাতায় পৌঁছে যাওয়া। দুর্গ যাওয়ার পথেই সদর বাজার। তারপর পায়ে হাঁটা পথে ইতিহাসকে চাক্ষুষ করতে এগিয়ে চলা। সেই বক্সা দুর্গ, যেখানে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বন্দি করে রাখত ব্রিটিশ সরকার। বক্সা দুর্গের সামনেই বক্সা ডাকঘর ও মিউজিয়াম। দুর্গের পরেই লেপচাখা গ্রাম। ছোট্ট গ্রামটিতে রয়েছে একটি বৌদ্ধ গুম্ফা, সঙ্গে নৈসর্গিক দৃশ্য। চোখের সামনে আলোয় ভাসা ভাললাগা। লেপচাখা থেকে ট্রেক করে পৌঁছে যাওয়া যায় রোভার্স পয়েন্ট ও রূপম ভ্যালি। লেপচাখা ইকো হাটে থাকা যায় বটে, তবে ইলেকট্রিসিটি বেশ অনিয়মিত। চোখে পড়ে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার। দিনের সবুজ আর রুপোলি রোদ লুটোপুটি খেলে। সব দুঃখ ভুলে থাকা যায়। তবে লেপচাখার রূপের গভীরতা খোলতাই হয় পূর্ণিমা রাতে। কেন যে এই এলাকাকে হেভেন অফ ডুয়ার্স বলা হয়, তা চোখের সামনে একটু একটু করে খুলতে থাকে। দূরের দিকে তাকিয়ে মনে পড়েছিল জটায়ুর সেই উক্তি, ‘এ কোথায় এলেম মশাই’।

তবে লেপচাখা নয়, পেখমের সঙ্গে আমার দেখা লাটপাঞ্চোরে। ভেবেছিলাম একটু অচেনা পাহাড়ে পা দেব। অচেনা আর কী! সেই তো মা দুগ্গার পিতৃভূমি হিমালয়। বার বার হাত নাড়ে। ওই ডাকে সাড়া না দিয়ে পারা যায় না। উত্তর বাংলার এত পাহাড়ি গ্রাম, যেখানে প্রকৃতি যেন উজাড় করে ঢেলে দেয় রূপের সাজি। তারই মাঝে নিজেকে আলাদা করে চেনায় লাটপাঞ্চোর। আলিপুরদুয়ার থেকে অনেকটা পিছিয়ে এসে গ্যাংটক যাওয়ার রাস্তায় কালিঝোরা। সেখান থেকে বাঁদিকে খাড়াই ভাঙাচোরা পাহাড়ি পথে আরও মিনিট পঁয়তাল্লিশ। তারপর সুন্দরী লেপচা গ্রাম লাটপাঞ্চোর। অনাবিল আকাশ-পাহাড়ের অন্তরিক হাসি দেখেছিলাম। হোম-স্টের নীচের তলায় মালিক থাকেন। দোতলা-তিনতলা পর্যটকদের জন্য। তেতলার একদম কোণার ঘরটায় ঘাঁটি গেড়েছিলাম। দুপাশে দুটো বিরাট জানলা। চোখ মেললেই গাছপালা-ছাওয়া পাহাড়ের রূপমাধুরী। রোদ-ঝলমল ব্যালকনি তো আছেই। ঠিক উল্টোদিকের হোম-স্টের তেতলায় আরেক রোদমাখা ব্যালকনিতেই প্রথম দেখেছিলাম পেখমকে। শাড়িতে আদ্যোপান্ত বাঙালি। কয়েকটা বাড়ি পরেই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। ফুটফুটে শিশুদের সার-বাঁধা আসা-যাওয়া দেখতাম। প্রতিটি বাড়িতেই টবে ফুলের বাগান। রংবেরঙের জানা-অজানা ফুল। সূর্য ডোবা আর ওঠার মাঝে নিঝুম রাত ঘন আবেগ বোনে, মন-পাখনায় ভালবাসা জড়ায়, ঘুম ঘুম জানলার কাচে স্মৃতির পাতা সেঁটে রাখে।

ভোর হচ্ছে। লাল সূর্যটা মুখ বাড়াচ্ছে ধীরে ধীরে। বারান্দা থেকে দেখছি পাহাড়-মেঘের ফাঁকফোকরে কাঁচা নরম আলোর ঝিকিমিকি। তখনই চোখে পড়ে উল্টোদিকের ব্যালকনিতে ভোরের মোলায়েম রোদ-মাখা স্নিগ্ধ অথচ কামনাকাঞ্চন মুখটা। কাটা কাটা চোখমুখে যেন যুদ্ধজয়ের নেশা। রুপোলি আভায় মথিত ওই ব্যালকনি নয়, চটকপুরের পথে চকিত চাহনি পেখমের মন-মদিরার দরজা খুলে দিয়েছিল। জঙ্গলের মধ্যে পাইন গাছের সারি পাশে রেখে অনেকটা নীচে। কড়া রোদ আর ঠান্ডা হাওয়ার মিশেল শরীরে জন্ম দিচ্ছিল রোমাঞ্চ। ভাললাগার ডুয়ার্স হাঁটতে হাঁটতে প্রাণের কাছে এসে আরও রূপসী হচ্ছিল। অন্য একটা রাস্তা ওপরে উঠে গেছে। বাঁধাকপি আর মুলোর খেত। তার ঠিক ওপরেই শুরু ফুলের বাগান। নিভৃত সুগন্ধ আর রঙিন মোহময়তা ছাপিয়ে হঠাত্‍্ই নাকে এসে লাগল এক নিষিদ্ধ আঘ্রাণ। উদাস মনে হঠাত্‍ ঝঙ্কার। গাঢ় নীল লং স্কার্ট আর আলতো হলুদ টপে ধরা দিল সে। গোলাপের বাগানে উবু হয়ে বসে গোলাপের পাপড়িতে হাত বোলাচ্ছিল মেয়েটা। পুরুষের অবাঞ্ছিত পায়ের শব্দে চোখ তুলে তাকাল। অদ্ভুত এক চাহনি জানান দিয়ে গেল, চটকপুর চটকের জন্যই বোধহয় পরিচিত। নির্জন প্রকৃতির প্রান্তরে দেখা হল, আলাপ হল, কথা হল, আবার-দেখার প্রতিশ্রুতি মিলল। বলা যেতেই পারে, দুই ব্যালকনির দূরত্ব কমল।

ব্যালকনিতে বসে কী লেখেন? গল্প না কবিতা?

পাইনের গোছানো সারির দিকে চোখ মেলে বললাম, ডুয়ার্সের কথা লিখি, অরণ্যের কথা লিখি, পাহাড়ের কথা লিখি, পাইনপাতায় সূর্যের স্পর্শের কথা লিখি, প্রেমের কথা লিখি, মন ভালর কথা লিখি, নারীর কথা লিখি।

আমার কথাও লিখবেন? আমার মন্দ-ভালর কথা? আমার কান্না-হাসি? আমার জয়-পরাজয়? আমার উত্থান-পতন? আমার প্রেম-অপ্রেম?

পাইনের বনে দুপুর ক্রমশ বিশ্রামের দিকে এগোচ্ছে। কখনও রোদ, কখনও ছায়া ঘিরে রাখছে বর্ণিল দুই ঠোঁট—আমি পেখম।

পেখম কই?

আমার প্রশ্নের উত্তরে আমার আঙুলটা ছুঁয়ে দিল সে। গোলাপের পাপড়িগুলো হঠাত্‍ খুলে দিতে শুরু করল না-বলা গল্প। পাইনের পথে পথে চটকপুর থেকে লাটপাঞ্চোর আরও কাছে আসতে লাগল। পেখমের আরও কাছে আসার অনুমতিগুলো একত্রিত হচ্ছিল।

আমি বই পড়ি না, পড়তাম। প্রেমের কবিতা পড়তাম। এখন শরীরের কবিতা পড়ি। পুরুষের শরীরকে তছনছ করার কবিতা পড়ি। জানি না, ওতে কবিতা আছে কি না। জানেন, জীবনানন্দ আমার বড় প্রিয়। মল্লিকা সেনগুপ্ত পড়তাম, জয় পড়তাম। যখন আকাশ আমার জীবনে এসেছিল। কবিতা পড়ার এক অদ্ভুত নেশা দিন দিন চেপে বসত। আজ বইয়ের পাতা ওল্টাই না। শুধু টাকা গুনি। লক্ষ লক্ষ টাকা। আর পুরুষের অহঙ্কার ছিঁড়েখুঁড়ে কঙ্কালসার করে দিই বিছানায়।

রূপমতী তিস্তার বয়ে চলার শব্দ হারিয়ে যেতে থাকল পেখমের ঠোঁটে। সিঙ্কোনা বাগিচায় হঠাত্‍ চোখে পড়ল একটা হর্নবিল। জানতাম, মহানন্দা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারির সবচেয়ে উঁচু জায়গাটাই হল লাটপাঞ্চোর। এখা্নে দেখা তো পাওয়ারই কথা হর্নবিল, বার্ন সোয়ালো, সুলতান টিট সহ অজস্র পাখির। এখান থেকে মংপুও খুব কাছেই। ঠিক করলাম পেখমকে প্রস্তাব দেব, রবি ঠাকুরের স্মৃতিজড়িত বাড়িতে ঘুরে আসার। রাজি হয়েছিল পেখম। লাটকোঠি, নামাথিং, পোখার, মানা হিলস, অহলদারাতেও যাই পেখমকে সঙ্গে নিয়েই। কী অদ্ভুত পথ চেনাতে চেনাতে নিয়ে গিয়েছিল পেখম। সবুজে মোড়া চারধার আর পাহাড়ের ঢালে ছোট ছোট বাড়িগুলো দেখে মনে হয়েছিল, পেখমকে নিয়ে বাকি জীবনটা ওখানেই কাটিয়ে দিই। বলেছিলাম পেখমকে। হেসে ফেলেছিল।

প্রায় দুবছর প্রেমের পর আকাশকে বিয়ে করেছিল। আস্তে আস্তে আকাশের আসল রূপ খুলতে থাকে। ড্রাগ, নারীপাচার এবং বউয়ের ওপর অত্যাচার। তারপর অগাধ সম্পত্তির মালিক ব্যবসায়ী বন্ধুদের কাছে বউকে কার্যত বিক্রি করে দেওয়া। প্রায় প্রতি রাতে হাতবদল হতে হতে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে পেখমের মন। যে মনে জন্ম নিতে থাকে প্রতিশোধ আর প্রতিহিংসার আগুন।

একটা সময় পর আমি আর শরীর বেচতাম না। মোটা টাকার বিনিময়ে উচ্চবিত্ত পুরুষের পৌরুষ ধুলোয় মিশিয়ে দিতাম। দিনের পর দিন লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করেছি। কিন্তু আমার পরিবার আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকায়নি। জানেন, ওই টাকা দিয়ে কী করি?

অবাক হয়ে শুনছি পেখমের কথা। এই যে লেপচা শিশুরা, ওদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছি। উত্তরবঙ্গের সব লেপচা বস্তিতে আমার অবাধ যাতায়াত। আমার পেশা হয়ত আর পাঁচজনের থেকে আলাদা। হয়ত সমাজ বাঁকা চোখে দেখে। কিন্তু সমাজ তো কোনওদিন জানতে চায়নি, কেন এই মেয়েটাকে এমন পেশা বেছে নিতে হল। জল, জঙ্গল আর পাহাড়ের কোলে বেড়ে ওঠা মেয়েটাকে কেন শহরের নিশি নিলয়ে পা রাখতে হল? কেউ তো প্রশ্ন করেনি? তা হলে বাঁকা চোখে দেখারও অধিকার নেই কারও। আমি হয়ত খুব বেশি লেখাপড়া শিখতে পারিনি। কিন্তু তাই বলে অন্ধকারে কেন নিক্ষেপ করা হবে? যাদের আপনজন ভেবেছি, নিজের ভেবেছি, তারাই কেন একটা মেয়ের শত্রু হবে? মেয়ে হয়ে জন্মেছি বলে কি বহু পুরুষের শয্যাসঙ্গী হতে হবে আমাকে? এ কেমনতর সমাজ, কেমনতর সংসার? এই সমাজ, এই সংসার আজ আমার পায়ের কাছে নতজানু। যারা আমায় পাঁকে টেনে নামিয়েছে, তাদের সবার শেষ দেখতে চাই আমি। পাশাপাশি এটাও দেখতে চাই, আমার মতো এই সব জনপদের অন্য কোনও মেয়েকে যেন এই পেশা বেছি নিতে না হয়। ওরা লেখাপড়া শিখবে। টাকাপয়সার জন্য ওদের লেখাপড়া কোনওদিন বন্ধ হতে দেব না। ওরা পেখমদিদিকে জানবে, কিন্তু তার পেশাকে নয়। দের বাবা-মাও কোনওদিন জানতে চায়নি। শুধু আমার মাথায় আশীর্বাদের হাত রাখে। সেটাই আমার ভবিষ্যতের পাথেয়।

দুদিনে পেখমের সঙ্গে বেশ কয়েকটা লেপচা গ্রামে ঘুরে বেড়িয়ে পেখমের মনের অনেকটা কাছে চলে এসেছিলাম। ছায়াঘন এমনই এক গ্রামে দাঁড়িয়ে আমার ঠোঁটে ছুঁয়ে গিয়েছিল পেখমের ঠোঁট। সে চুম্বনে বিতৃষ্ণা ছিল না, আবেগ ছিল। ঘেন্না ছিল না, বন্ধুতা ছিল। প্রতিশোধের গর্জন ছিল না, প্রমের কুহুতান ছিল।

আবার প্রেমে পড়তে ভয় করবে না?

সব ভয় প্রথম প্রমেই ফেলে এসেছি। আর কিছু হারানোর আছে কি? যারা কবিতা লেখে, তারা শত্রু হতে পারে না।

পেখমের কথাগুলো পাইন সারিয়ে দোল খাচ্ছিল। হঠাত্‍ ডুব দিল রোদ। ছায়া আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিল দুটো শরীর। আমার ডান হাত পেখমের বাম কাঁধে রাখতেই একটা ভরাট নারী শরীর বুকে এসে মিশে যেতে চাইল। পেখমের পিঠে আলতো হাত রাখলাম। চার ঠোঁট এক হল। পাহাড়ের ভাঁজে ছায়া আরও গভীর হল। আবেগ আরও জমাট বাঁধল। আমার কানে ঠোঁট ছোঁয়াল পেখম।

আবার প্রেমে পড়তে চাই। জঙ্গল-পাহাড়ের অলিন্দে শব্দগুলো ধাক্কা খেতে খেতে লাটপাঞ্চোরের ব্যালকনিতে আশ্রয় নিল। রাত যত গভীর হল, দুটো শরীর তত নৈকট্যের আলিঙ্গনে উষ্ণ হয়ে উঠল। ভোর হল প্রেমের পেখমে সাতরঙা আলো মেখে।

সেই থেকে ডুয়ার্সের ভোর হাতছানি দেয়। লাটপাঞ্চোরের সেই ব্যালকনি, চটকপুরের সেই পাইন সারি কাছে ডাকে। লেপচা শিশুদের দেখলে তাদের দিদির কথা মনে পড়ে যায়। ডায়েরির পাতা নতুন করে গল্প বুকে ধরতে চায়। ডুয়ার্সের সবুজ বনানী পেখমকে খুঁজে বেড়ায়। আমি স্মৃতি হাতড়াই। হঠাত্‍ ডায়েরির কয়েকটা ছেঁড়া পাতা আমার ব্যালকনিতে উড়ে আসে। আমি মুঠো করে ধরি।

Leave a Reply

Your email address will not be published.