অরণ্য সুন্দরীর কাছাকাছি।। অনিন্দিতা মিত্র

একটানা দীর্ঘ দৈনন্দিন জীবন অতিবাহিত করার পর মন মুক্তি চায়। খোলা আকাশ, জঙ্গলের প্রান্তর মনের ভেতরে কড়া নেড়ে যায়। ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে ভ্রমণ হলো নেশার মতো, বাঙালির রক্তে মিশে আছে ঘোরার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। ছুটি পেলেই আমরা ঘুরতে যেতে চাই। করোনার আগমন বর্তমানে আমাদের অবাধ গতিবিধি ও মেলামেশায় নিয়ে এসেছে পরিবর্তন এবং নিয়ন্ত্রণ। মন মানে না, মন মাঝে মাঝে পাখির মতো ডানা মেলে উড়তে চায়। দুদিন ছুটি পেতেই চলে গেলাম মুকুটমণিপুরের পথে।

সংবাদপত্র এবং সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন লেখায় পড়েছি সুতানের জঙ্গল এবং ঝিলিমিলির কথা। মনের কোণে  ইচ্ছে ছিল মুকুটমণিপুরে গেলেই একবার ঝিলিমিলিতে ঢুঁ মারবো। মুকুটমণিপুর যাওয়ার সময় পথে পড়লো জয়পুরের বিস্তীর্ণ জঙ্গল। কলকাতা থেকে মুকুটমণিপুর যেতে গাড়িতে  সময় লাগে প্রায় ঘন্টা ছয়েক। সাঁতরাগাছি এবং শালিমার থেকে ট্রেনেও বাঁকুড়া যাওয়া যায়। ওখান থেকে অতি সহজেই  মুকুটমণিপুরে পৌঁছে যাওয়া যায়। ট্রেন, গাড়ি ছাড়া বাসেও যাওয়া যায়। মুকুটমণিপুরে যখন পৌঁছলাম তখন বেলা গড়িয়ে গেছে। চারদিকে টিলা ঘেরা সবুজ গাছগাছড়ার মাঝে মুকুটমণিপুর অবস্থিত। এখানে থাকার জন্য ছোট ছোট অনেক কটেজ, হোটেল আছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সহজেই বুকিং করে নেওয়া যায়। এখানেই আছে এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম আর্থ ড্যাম। আপন খেয়ালে বয়ে চলেছে নদী কংসাবতী। ড্যামের ওপরে হাঁটার ব্যবস্থা আছে। এখান থেকে হেঁটে অথবা অটো করে চলে যেতে পারেন মুসাফিরানা পয়েন্ট। এই পয়েন্ট থেকে মুকুটমণিপুরের অপরূপ সৌন্দর্য দেখা যায়। ড্যামের এক প্রান্তে যেমন কলকলিয়ে বয়ে চলেছে নদী কংসাবতী, তেমনই অপর প্রান্ত থেকে হাতছানি দিচ্ছে সবুজে মোড়া দলমা পাহাড়। কংসাবতী নদীতে বোটিং করাই যায়।

লাঞ্চ সেরে  নদীর পাড়ে এসেই দেখলাম  টলটলে নদীর জলে এসে পড়েছে পড়ন্ত রোদ্দুরের সোনালি ছায়া। উঠে বসলাম একজন মাঝিভাইয়ের নৌকায়।  যতদূর চোখ যায়, দেখা যায় ছোট্ট ছোট্ট অরণ্যের দ্বীপ।  কিছুটা যেতেই গিয়ে পড়লাম কংসাবতী আর কুমারী নদীর সঙ্গম স্থানে। এখানে দুই নদী পরস্পরের সঙ্গে কানাকানি করছে, কাছেই রয়েছে বনপুকুড়িয়া উদ্যান। ঘন ঘাসের বন পেরিয়ে ভ্যানে করে যেতে হয়। হাতে সময় থাকলে ঘন সবুজ বনের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যাওয়াই যায়। সব ঋতুর মতো বর্ষারও একটা নিজস্ব রূপের বাহার আছে, নিজের জলের ধারায় সে ধুয়ে দেয় সবকিছু।  গাছপালা আরো সজীব ও সবুজ হয়ে ওঠে বর্ষার ছোঁয়ায়। ওখানে যেতেই দেখলাম এক অনুপম দৃশ্য, রঙবেরঙের বলগা হরিণ উঁকি মারছে খাঁচার ভেতর থেকে। কাছেই আছে সোনার বাংলা পার্ক। ফুলে ফুলে মাঠ ভরে আছে। কিছু রাজহাঁস অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত।

নদীর পাড়ে এসেই দেখলাম সূর্যদেব প্রায় পাটে চলেছেন, দিনের শেষ গোধূলির আলো পড়েছে দুই নদীর বুকে। ঝিকিমিকি রোদের আভা মেখে ঝুপ করে বনের ভেতর মিলিয়ে গেল একটা হরিয়াল। তারপর চললাম পরেশনাথ মন্দিরের পথে।  এবড়ো-খেবড়ো টিলার মাঝে অবস্থিত এই মন্দির। মন্দিরের লোকজনের মারফত জানা গেল যে বেশ কিছু বছর আগে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের কিছু মূর্তির সন্ধান মেলে কংসাবতীর বুকে। সেই মূর্তিগুলি জল থেকে তুলে এনে এখানে রাখা হয়। বাংলার বহুত্ববাদী ঐতিহ্যের এই মিলনক্ষেত্র দেখে আনন্দ পেলাম। মন্দির থেকে নদীর তীরে যেতে যেতে বুঝতেই পারিনি যে কখন ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এসেছে। ঘাটের আশেপাশে স্থানীয় মানুষের কিছু দোকানপাট আছে। বাঁকুড়া জেলার হাতের কাজ আর পোড়ামাটির জিনিসপত্রের কদর বিশ্বব্যাপী। অনেক মানুষের পেটে ভাত জোগায় হস্তশিল্প। তাই পর্যটন শিল্পের উন্নতি নিয়ে চিন্তাভাবনা করা খুব দরকার। করোনা ভাইরাসের দাপটে এই শিল্প গুরুতর সঙ্কটের মুখে পড়েছে। সুচিন্তিত পরিকল্পনা গ্রহণ করে এই শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করা একান্ত কাম্য।

পরদিন খুব ভোরেই ছুটলাম ঝিলিমিলির দিকে। আপনারা চাইলে ঝিলিমিলিতেও থাকতে পারেন। কটেজ, লজ, ট্রি হাউসে থাকার সুব্যবস্থা আছে। ঝিলিমিলি যাওয়ার পথে রাস্তার দুপাশে চোখে পড়লো ঘন সবুজ জঙ্গল। সকালের রঙ গিয়ে পড়েছে জঙ্গলের গায়ে। ঘুম থেকে উঠে পাখিদের  দল ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে। শহরে আজকাল বিশাল বিশাল ইমারত আর স্কাইক্রাপারের দৌলতে চড়াই, ফিঙে, মাছরাঙা,কাঠঠোকরাদের দেখা মেলে না। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গেলে সহজেই দেখতে পেতে পারেন মাছরাঙার টুপটাপ মাছ ধরার ফন্দিফিকির। দেড় ঘণ্টার মধ্যে চলে গেলাম ঝিলিমিলিতে । শাল,মহুয়া, সোনাঝুরি, পিয়ালের জঙ্গলে হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো চলে এসেছি কোনো এক রূপকথার রাজ্যে। পথে চলতে চলতে চোখে আসবে আদিবাসী মানুষজনের জীবনযাত্রার নানা চিত্র। পাথুরে, রুক্ষ্ম জমিকে চাষের জন্য উপযুক্ত করতে গিয়ে এখানকার স্থানীয় লোকজন অমানুষিক পরিশ্রম করেন।

গ্রীষ্মকালের তীব্র দাবদাহের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে তাঁদের জীবনযুদ্ধ চালাতে হয়। সুতানের জঙ্গল এবং ঝিলিমিলি সংলগ্ন অঞ্চলে সহজেই দেখা মিলতে পারে ময়ূর,বনমোরগ, খটাশ, শিয়ালের। ঝিলিমিলির খুব কাছেই রয়েছে তালবেড়িয়া জলাধার। এখানে গিয়েই মনে হচ্ছিল যে প্রকৃতি যেন নিজেই নিজের সঙ্গে কথা বলছে। চারপাশের অদ্ভুত নির্জনতা মানুষকে আকৃষ্ট করবেই। জলাধারের জল ঠিক পান্নার মতো গাঢ় সবুজ, চারপাশের গাছগাছালির সবুজ ছায়া পড়েছে জলে। কিছুটা দূরেই নৌকা বাঁধা আছে, ইচ্ছে করলে নৌকায় চড়া যায়। শহরের চাকচিক্য ও যান্ত্রিক সভ্যতার হট্টগোল থেকে কদিন নিস্তার পেতে  চাইলে এখানে যাওয়াই যায়। চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মনে হতে পারেই যে একজন দক্ষ শিল্পী নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে এঁকেছেন এক অত্যাশ্চর্য ছবি। জলাধারের জলে পা ভিজিয়ে অনুভব করা যায় নির্মল ও অনাবিল তৃপ্তির অনন্য এক অনুভূতি। বসন্তের সময় এই অঞ্চল পলাশ, শিমুল, মহুয়া ফুলে ভরে যায়, প্রকৃতি তখন রঙের বাহারে রঙিন হয়ে ওঠে। এই সময় গেলে প্রকৃতির রঙিন রূপ দেখা যায়। অবশ্য এখন আমাদের জীবনযাত্রা ঘড়ির কাঁটার অধীনে চলে, ইচ্ছে থাকলেও অনেক সময় উপায় থাকে না। আনন্দের মুহূর্তে আয়োডিনের মতো উবে যায়, কাজের জগতে আমাদের ফিরে যেতে হয়। আমাদেরও ফেরার পালা ঘনিয়ে এলো, জঙ্গলের আঁকাবাঁকা পথ ধরে ফিরলাম গ্রাম গ্রামান্তর হয়ে শহরের মাঝখানে। মনে রয়ে গেল একরাশ টাটকা তরতাজা স্মৃতি।

Leave a Reply

Your email address will not be published.