পুজো মানেই তো কেনাকাটা, হইচই, আলোঝলমল-বাজনাবাদ্যি, ভিড়ভাট্টা, নতুন জামাকাপড়ের ভিড়ে হারিয়ে গিয়ে ঠেলাঠেলি, পুষ্পাঞ্জলি, ঢাকের বাদ্যি, ধুনুচি নাচ! লকডাউন হয়তো পরিস্থিতির সামান্য অদলবদল করেছে, কিন্তু চিত্র কিন্তু এমনই সর্বত্র! কেমন পূজো আসে পরবাসে? কেমন পরবাস? এই ধরা যাক গ্রামবাংলা ছাড়িয়ে খানিকটা দূরেই, এই কলকাতা-ডায়মন্ড হারবার-তিব্বত ছাড়িয়ে সোজা আমার শহর, নিউ ইয়র্ক! এখানেও তো হাজার হাজার বাঙালীর বাস! কেমন হয় এখানে পুজো? এখানে তো পথের মাঝে প্যান্ডেলও হবেনা, পাঁচদিন ছুটিও দেবেনা, তাহলে? সোজা হিসেব, যেখানে বাঙালি রয়, সেখানেই পূজো হয়! অল্প করে বলেই ফেলি নিজের অভিজ্ঞতার কথা!
নিউইয়র্কের প্রাচীনতম ও বৃহত্তম সার্বজনীন পূজো হয় ইস্ট কোস্ট দুর্গাপূজা এসোসিয়েশন (ECDPA), যেটি চালু হয়েছিল একান্ন বছর আগে, ১৯৭০ সালে, কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি হলে! আজ সে পুজো হয় কুইন্স-এর গুজরাটি সমাজ হলে, কারণ তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠান, প্রায় আড়াই হাজার মানুষের সারাদিনের হইচই, পূজো দেওয়া, ভোগ বিতরণ, দশটির বেশি স্টলের পসরা ও ভারত-বাংলাদেশ থেকে আসা নামীদামী নক্ষত্রদের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে গেলে ম্যানহাটানে জায়গা কুলোয় না! সেপ্টেম্বর-অক্টোবর নাগাদ ঠান্ডা তো পড়বেই! তাইবলে কি শাড়ী-গয়না-ধুতি-পাঞ্জাবী-কোলাপুরী চটির সাজের অভাব হবে? নাই বা মানা হলো তিথি-নক্ষত্র, রুমহিটার চালিয়ে তাপনিয়ন্ত্রিত ভোগের গন্ধে ম’ম’ করা শারদসন্ধ্যায় পুজোমণ্ডপ! একদিকে প্রতিমা, সামনে ধূপ-ধুনো-চন্দনের গন্ধ, স্তুপাকারে ফুল, ঢাক-কাঁসরের আরতি, পঞ্চপ্রদীপের উত্তাপ, সুস্পষ্ট মন্ত্রোচ্চারণে বোধন-সন্ধিপুজো-বিসর্জন-ধুনুচিনাচ-সিঁদুরখেলার পালাবদল, অপরদিকে সুবিশাল মঞ্চে নক্ষত্রসমাগম। সামনে সারিসারি চেয়ারে দর্শকের হাততালি। এই দর্শকাসন ঘিরে গোল করে বসে শাড়ি-পাঞ্জাবী-গয়না-খাবারের স্টল। বাংলায় হৈহৈ করে কথা বলা বাঙালিসাজে বাঙালি-সমাগম – বুঝতেই পারা যায়না এটা কলকাতা না নিউইয়র্ক! লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই ফেলি – আমেরিকায় আসার পর এই পুজোতেই আমার প্রথম সৌভাগ্য হয়েছিল মঞ্চে উঠে ঘন্টাদেড়েক গান শোনানোর! তখন ২০১৬, সদ্য এসেছি এ দেশে, পিএইচডি প্রোগ্রামে সদ্য পা রাখা আমি এতো গমগমে চারিদিক, এতো নতুনত্বঘেরা পুজোয় গান শোনানোর আমন্ত্রণ পেয়ে আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেছিলাম। এতো মানুষ টিকিট কেটে এসেছেন অত বড় মঞ্চে আমারও গান শোনার জন্য! দেশে গান শুনিয়ে অনেক হাততালি কুড়িয়েছিলাম আগে, কিন্তু বিদেশে প্রথমবার ওই মঞ্চ আমায় অদ্ভুত ভালোলাগা দিয়েছিলো। প্যানডেমিকে কিঞ্চিৎ থিতিয়েছে ঠিকই, কিন্তু অনলাইন জাঁকজমকের কমতি কিন্তু নেই! এ বছর দুমাস আগে থেকেই এসে গেছে বিজ্ঞাপন, কলকাতার রিয়ালিটি শো-খ্যাত দুই শিল্পীর আগমনবার্তা, সেইসঙ্গে আমেরিকায় থাকা ভারতীয়-বাংলাদেশীদের অনুষ্ঠানের খবর, পুজোর রেজিস্ট্রেশন লিঙ্ক, শাড়ী-পাঞ্জাবীর দোকানের ভার্চুয়াল লিফলেট। নেহাত কনফারেন্স পড়ে গেছে, নাহলে এ বছর ECDPA-র পুজো মিস করতাম না।

সাঁইত্রিশ বছর আগে দশটি ভারতীয় গবেষক/বিজ্ঞানী পরিবার তাঁদের পরবর্ত্তী প্রজন্মকে দুর্গাপূজো ও বাঙালিয়ানার উষ্ণতাটুকু পাইয়ে দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন নিউ ইয়র্ক সার্বজনীন দুর্গাপূজো এসোসিয়েশন (NYSDPA)! নাম যদিও সার্বজনীন, পরিবেশ কিন্তু অনেকটাই বাড়ীর পূজোর মতো। চাঁদার বালাই নেই, ইচ্ছেমতো অনুদান, ভোগ-সিঁদুরখেলা ও ধুনুচিনাচের আন্তরিকতা বড্ড পারিবারিক! এই পূজোও তিনদিনব্যাপী, এখানেও হয় দেশ-বিদেশের তারকার আবির্ভাব! এখানেও গান শুনিয়ে মন জয় করতে পেরেছিলাম ২০১৯এ, দেড় ঘন্টার অনুষ্ঠানে সঙ্গী হয়েছিলেন নিউজার্সির দুই স্বনামধন্য বাদ্যযন্ত্রী। অনুষ্ঠানশেষে ভোগখাওয়া, খেজুর-আমসত্ত্বের চাটনিটা চেটেপুটে খেয়েছিলাম। আমার অনুষ্ঠান ছিল নবমীর দিন, তবে আমার অনুষ্ঠানে যত মানুষ আসবেন আশা করা গেছিলো, তা হয়নি, কারণ? পাশের রাজ্য নিউ জার্সিতে এক মঞ্চে সেই সন্ধ্যাতেই গান শোনাচ্ছিলেন হরিহরণ জী। সে পুজোর কথাতেও আসছি। আমার নিজের অনুষ্ঠান না থাকলে আমিই হরিহরণজীর অনুষ্ঠান মিস করতাম না! তার পরেও যে হলে শ’দেড়েক মানুষ আমার জন্য এবং আমার পরবর্ত্তী রিয়েলিটি শোখ্যাত বাংলাদেশী শিল্পীর জন্য ছিলেন, এতে আমি ধন্য।
এই দুই ভিন্নস্বাদের প্রাচীনতম পূজো ছাড়াও এ বছর ছাব্বিশে পা দিলো নিউ ইয়র্ক পূজা এসোসিয়েশন (NYPA)! পঁচিশের প্রস্তুতি ভেস্তে এসেছিলো প্যান্ডেমিক, এবছরেও সবটুকু স্বাভাবিক না, তবু তাঁরাও লেগে পড়েছেন কোমর বেঁধে! এছাড়াও তিথি-নক্ষত্র মেনে পুজো হয় ফ্লাশিংয়ের বাংলাদেশ হিন্দু মন্দিরে, মহামায়া মন্দিরে ও লং আইল্যান্ড কালীবাড়িতে! ভক্তি ও শান্তির মতোই ধূপ-ধুনো-চন্দন-ফুলের অভাব নেই সেখানে! সেখানে ভোজন ও ভজন এক্কেবারে প্রথাগত। মা দুর্গার সামনে কার্পেটে বসে প্রতিবছর চোখে জল এসেছে ভক্তিতে! কাচের অনুদান বক্সে টাকার বদলে ডলার দেখতে পাওয়া ছাড়া আর কোথাও বিদেশের কোনো ছোঁয়া নেই সেখানে।

এবার যাওয়া যাক পাশের পাড়ায় নিউ জার্সিতে। কল্লোলের পুজোর নাম তো ভারত থেকেই শুনতে পায় লোকে! এত বড় সার্বজনীন পূজো নর্থ আমেরিকায় আর নেই! প্রতিবছর এখানে হয় নতুন থিম নতুন চমক! ২০১৯এ কলাবৌ এসেছিলেন লিমুজিন চড়ে! তিনদিনব্যাপী পুজোতে তিনদিনেই সেলেবরা আসেন। সেখানে ফ্যাশন শো থেকে ক্লাসিক্যাল নাইট, জমাটি বাঙালী মেনু থেকে শুরু করে প্রাদেশিক খাবারের রকমারি সম্ভার, ঢাকের বাজনার সাথে দিদি নম্বর ওয়ানের মত প্রতিযোগিতা, দফায় দফায় কুইজ শো – কি থাকে না! কল্লোল ম্যাগাজিনে গতবছর অধমের একটি ছোট্ট লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। রোমাঞ্চ হয়েছিল ভেবে যে পত্রিকায় এক সময়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, পূর্ণেন্দু পত্রী প্রমুখ স্বনামধন্য বাঙালী সাহিত্যিকেরা নিয়মিতভাবে যুক্ত ছিলেন, সেই “আকাশভরা সূর্য তারা”র মাঝে “আমি পেয়েছি মোর স্থান”! প্যানডেমিকে এখন দিকে দিকে ফান্ডরেজার, কিন্তু কল্লোলের চ্যারিটি উইং “মেধা” কিন্তু বহুদিনের গৌরবের জায়গা। এঁরা বঞ্চিত শিশুদের পাশে থেকে ইন্ডিয়াতে আটটি এবং এখানে দুটি স্কুলকে সাহায্য করে|
আকারে-প্রকারে বা প্রাচীনতার প্রতিযোগিতায় না গিয়েও হরিহরণের মতো শিল্পীকে আনার জন্য ২০১৯এ পুজোর প্রচার শুরু হতে না হতেই টিকিট শেষ হয়ে গেছিলো গার্ডেন স্টেট কালচারাল এসোসিয়েশনের (GSCA) পূজোয়! জাঁকজমক বা লোভনীয় মেনু সেখানেই বা কম কি! তাঁরা নর্থ আমেরিকার লোকাল গায়ক-গায়িকাদের জন্য আয়োজন করেছিলেন GSCA আইডল রিয়ালিটি শো। এ ছাড়াও বেশ বড় পুজো হয় ইন্ডিয়ান কমিউনিটি স্টেট্ (ICC) এ! ২০১৯এ লাইভ গান শুনিয়ে গেছেন কিংবদন্তি কবিতা কৃষ্ণমূর্তি! জাঁকজমকের পাশাপাশি প্রথা ও তিথিনক্ষত্র মেনে পূজো হয় নিউ জার্সিতেও! আনন্দ মন্দির, ভারত সেবাশ্রম সংঘ ইত্যাদি জায়গাগুলিতে নির্জলা উপবাস করে অঞ্জলির রীতি রমরম করে চলছে আজও। এছাড়াও আছে বেশ ২-৩ টি পূজো নিউ ইয়র্ক-নিউ জার্সিতে। তাছাড়া শুধু কি পুজো? তার আগে মহালয়ার আয়োজনও হয় বেশ ধুমধাম করেই কয়েক জায়গায়! আমি নিজেও এমন দু-এক মহালয়ার অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলাম।
প্যান্ডেমিক আসায় পরিস্থিতি একটু পাল্টায় গত বছরে। দিকেদিকে মৃত্যুমিছিল পুজোর আগে নিউইয়র্কে, হাসপাতালে বেড সংকুলান হচ্ছিলো না। অনেকেই আত্মীয়-বন্ধু হারিয়ে সে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। আমার মতো যাঁদের এ দেশে কেউ নেই, আত্মীয়-বন্ধুরা সবাই ভারতে, তাঁদের মতো মানুষের জন্য পুজো শুধুই এদেশে নিজে সুস্থ থাকার দায়িত্ব আর বিদেশে পরিবারের সুস্থতার প্রার্থনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমার মতো অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় ভার্চুয়াল অঞ্জলির খোঁজ নিতে শুরু করেছিল। অধিকাংশ পুজোই ভার্চুয়াল। অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা ভার্চুয়াল হওয়াতে সুবিধে হয় দেশবিদেশের বেড়া ভেঙে পৃথিবীর যেখানে হোক অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার সুযোগ ছিল। আমি পেশায় পদার্থবিদ, তাই আমার ল্যাবরেটরি প্যানডেমিকে বেশ লম্বা সময় জুড়ে বন্ধ ছিল। মানসিকভাবে যেন মহাশূণ্যে বিচরণ করছিলাম। সে সময় বিভিন্ন অনলাইন অনুষ্ঠান আমার মতো মানুষদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছিলো। আমি নিউইয়র্কে বসে অঞ্জলি দিয়েছিলাম লন্ডনের পুজোয়। আমেরিকা তো বটেই, ভারত-বাংলাদেশ-ইউরোপ-অস্ট্রেলিয়ার নানা ভার্চুয়াল পুজোর আড্ডায় অংশ নিতে পেরেছিলাম। সব মঞ্চই সৌভাগ্যের, তবু তার মধ্যেও কিছু জায়গার প্রতি মানুষের আলাদা টান থাকে। ওই প্যানডেমিকের মধ্যেও GSCA-র ডিজিটাল কনসার্টে ভার্চুয়াল মঞ্চে আমার গান শোনার জন্য মানুষ টিকিট কেটেছিলেন জেনে অবাক লেগেছিলো। ঠিক তেমনি আনন্দ হয়েছিল সুদূর ইউরোপে ইয়র্কশায়ার বেঙ্গলি এসোসিয়েশন ভার্চুয়াল পুজোয় গান শোনানোর পর এক গোছা টাটকা হলুদ গোলাপগুচ্ছ নিয়ে বাড়ির দোরগোড়ায় মাস্কপরা ফ্লোরিস্ট এসে দাঁড়ানোয়! মনে হয়েছিল যেন প্ৰসাদ খেলাম। সুদূর জার্মানির ভার্চুয়াল পুজো “ইচ্ছে”তে গান শুনিয়ে মন ভরে গেছিলো। একইরকমভাবে লেখার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম বেশ কিছু শারদীয়া পুজোবার্ষিকীতে। কল্লোল, আনন্দ মন্দির ইত্যাদি কিছু সংস্থা মণ্ডপের পুজোর আয়োজন করেছিলেন ঠিকই, তবে অত্যন্ত বেশি সতর্কতা মেনে সেসব পুজোয় খুব কম মানুষ অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছিলেন।

লকডাউন পার করে ভ্যাকসিনেটেড নিউইয়র্কের পুজোর চিত্র কিছু বদলেছে। ECDPA র কথা আগেই বলেছি। বাকি পুজোগুলোরও প্রস্তুতিপর্ব সব শেষ। প্রকাশিত হয়ে গেছে শিল্পীদের তালিকা, খাবারের মেনু, রেজিস্ট্রেশন লিংক, শারদীয়া স্মরণিকা। কিছু কিছু মণ্ডপে এবারেও আসছে দেশবিদেশের শিল্পীরা। নিয়ম মেনেই পুজো হবে, ভিড় এড়িয়ে। তবে মানুষের মন এবছর বদলেছে। এখনো যেহেতু শতকরা একশোভাগ ভ্যাকসিন হয়নি, তাই এখনো মানুষ ভয়ে আছেন। আমিও সতর্ক আছি। সাহস করিনি এখনো ভিড়মণ্ডপের মঞ্চে যাওয়ার। তবে হ্যাঁ, তাইবলে শপিংয়ের কমতি হয়নি। এবছর দেশে যাওয়া হয়নি, তাই অনলাইনে নিউজার্সির বুটিক থেকেই কিনে ফেলেছি নতুন শাড়ী, শিপ করে চলেও এসেছে হালফ্যাশনের ব্লাউজ। বন্ধুরা মিলে হয়তো একদিন মন্দির যাবো, প্ল্যান চলছে। খুব ভিড় দেখলে হয়তো বা বাইরে থেকেই প্রণাম করে ফিরতে হবে! সে যাই হোক, বুঝতেই পারছেন, বাংলার মতো পাঁচদিনে পায়ে নতুন জুতোর ফোস্কা পরিয়ে নাই বা হলো, গোটা অক্টোবর মাস ধরে সবকটা উইকেন্ডেই এই রাজ্যদুটি মিলিয়ে চলবে একগাদা পূজোর আয়োজন! তিথিনক্ষত্র মেনে মন্দিরগুলোতেও পুজো হবে। প্যান্ডেমিক তো কখনো না কখনো কাটবেই, বাঙালী প্রবাসে থাক বা দেশে, চলতে থাকবে শপিং, গসিপিং আর প্যান্ডেল হপিং, কারণ আমার মতো প্রবাসী বাঙালির মনও ঠিক কলকাতায় থাকা বাঙালীর মতোই মহালয়ার সকালে গেয়ে ওঠে “বাজলো তোমার আলোর বেণু, মাতলো রে ভুবন”!
সুদূর নিউইয়র্ক থেকে কলম চুঁইয়ে শারদ শুভেচ্ছা পাঠালাম।