অলকে-তিলকে দুর্গা।। শ্রাবণী ঘোষমিত্র

দেবী দুর্গা দশভুজা। দশপ্রহরণধারিণী। মহিষাসুরমর্দিনী। পুরাণখ্যাত মহাসুরকে বধ করে তিনি মহাদেবী। তাই শরৎকালে তাঁকে ঘিরেই আমাদের আনন্দমণ্ডিত শারদোৎসব। করজোড়ে প্রার্থনা “রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।”

কিন্তু দেবী কি সত্যিই শুধুমাত্র রণসজ্জায় সজ্জিতা এক মহীয়সী যোদ্ধা! -এর উত্তরই খুঁজব আজকে।

মহাসংগ্রামকালে দেবীকে আমরা প্রত্যক্ষ করি ‘রণং দেহি’ রূপে। মৃণ্ময়ী মূর্তিতেও তাই। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই যুদ্ধবেশের আড়ালে চোখে পড়ে যায় তাঁর বিশাল অলঙ্কার ও প্রসাধনের সম্ভার। মাথায় মুকুট, কপালে টিকলি, গলায় কণ্ঠহার, হাতে চুড়ি-বালা-বাজুবন্ধ-মানতাসা, পায়ে নূপুর, কোমরে চন্দ্রহার, কানে ভারী দুল, এমনকি নাকে নথ পর্যন্ত। অর্থাৎ ‘মহিষমর্দিনী’ রূপে শুধু যোদ্ধা নয় মায়ের চিরাচরিত নারীভাবটিও মুখ্য হয়ে ওঠে এখানে। সমরপ্রিয়া দেবী ওঠেন প্রসাধনপ্রিয়া। নানাবিধ অলংকার এবং সর্বপ্রসাধন ভূষিতা এক নারী।

এহেন দেবীর যাবতীয় অলঙ্কারাদির যে তথ্য শ্রীশ্রীচণ্ডীতে পাওয়া যায় তাতে বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হয়না যে অলঙ্কারের প্রতি নারীজাতির এই অনন্তকালীন মোহ বিষয়ে দেবগণ বিলক্ষণ জানতেন। এবং সে কারণেই দেবীর সমগ্র অলঙ্কারের দায়িত্ব তাঁরা তুলে দিয়েছিলেন সমুদ্র (ক্ষীরসাগর), পাতাল (নাগলোক) এবং পর্বত (গিরিরাজ)-এর ওপর। কারণ এই তিন স্থানই ত্রিলোকের সমগ্র মহামূল্যবান রত্নের আকর। আর যুদ্ধকালে এঁরাই সর্বোৎকৃষ্ট অলঙ্কারে সুসজ্জিত করেছিলেন দেবীকে।

ক্ষীরসমুদ্র দিয়েছিলেন তাঁর উজ্জ্বল মুক্তাহার, চিরনূতন বস্ত্রসম্ভার, দিব্য চূড়ামণি (মাথার মুকুট), কুণ্ডল (কান বালা), হাতের বলয় (বালা), ক্ষুদ্র ললাটভূষণ (ললাটিকা বা তিলক), অঙ্গদ (বাজুবন্ধ), সুরঝঙ্কারি নূপুর এবং শ্রেষ্ঠ অঙ্গুরীয় (আংটি)। গিরিরাজ হিমালয় দিয়েছিলেন নানাবিধ রত্ন এবং নাগরাজ বাসুকি মহামণিশোভিত নাগহার। অবশ্য সমুদ্র যা দিয়েছিলেন তার সাথে আধুনিক ফুলের সাজের তুলনা করাই যায়। দেবীর শিরে ও বক্ষে ছিল তাঁর দেওয়া অম্লান পদ্মের মালা এবং হাতে একটি পরমসুন্দর পদ্ম। অর্থাৎ মণিমাণিক্যয় রুচি না হলে তিনি ফুলসাজে এমন স্নিগ্ধা অনির্বচনীয়া সৌম্যারূপেও বিরাজিত হতে পারেন। এ এক ধরনের বৈকল্পিক সজ্জা। যেন গয়নার ভার থেকে সামান্য বিরাম।

যদিও শ্রীশ্রীচণ্ডীতে দেবগণ করজোড়ে মহাদেবীর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করে বলেছেন— “মুক্তাকেয়ূর-কঙ্কণ, সুমধুর ধ্বনিসংযুক্তা চন্দ্রহার ও নূপুর পরিহিতা হে দেবী আমাদের রক্ষা করুন, মণিমাণিক্যখচিত কণ্ঠহার, রত্নোজ্জ্বল বলয়-অঙ্গদ-কুণ্ডলভূষিতা হে দুর্গা আমাদের দুর্গতি নাশ করুন।” অতএব এর থেকে বোঝাই যায় যে অস্ত্রসজ্জায় সুসজ্জিতা দেবী সাধারণত নানা রত্নালংকার বিভূষিতা হয়ে থাকতেই ভালবাসেন এবং ততোধিক স্বাচ্ছন্দ্যও বোধ করেন। যুদ্ধ নিয়ে তাঁর বাড়তি কোনো ভাবনা নেই। খানিকটা যেন সেই “যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে” গোছের ব্যাপার। সেকালের চিন্তাধারায় একালের উদ্ভাস।

তবে দেবী সত্যি-সত্যি আদৌ চুল বাঁধেন কিনা- সে বিষয়টা গোড়া থেকে কিছুটা অস্পষ্টই রয়ে যায়। কারণ তাঁর মৃন্ময়ী মূর্তিতে যা আমরা দেখি তা দীর্ঘ-কুঞ্চিত-তরঙ্গায়িত কেশদাম। মা সেখানে এলোকেশী। কিন্তু আদি শঙ্করাচার্য রচিত “মহিষমর্দিনী স্তোত্র”-তে এ-বিষয়ে একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কুড়িটি শ্লোকের এই স্তোত্রে দেবীকে তিনি সম্বোধন করেন “অয়ি গিরি নন্দিনী” অর্থাৎ হিমালয় কন্যা হিসেবে। আর প্রতিটি শ্লোকের সমাপ্তিতে বলেন “জয় জয় হে মহিষাসুরমর্দিনী রম্যকপর্দিনী শৈলসুতে।”

এই ‘রম্যকপর্দিনী’ শব্দটিতেই লুকিয়ে আছে মাহাত্ম্য। এই কথার অর্থ যাঁর খোঁপা সুন্দর করে বাঁধা। অর্থাৎ দেবী যে যথেষ্ট যত্ন সহকারে তাঁর কবরী বিন্যাস করে থাকেন সেকথা এখানে সুস্পষ্ট।

এছাড়াও দেবীর সালংকারা রূপটি এই স্তোত্রের বিভিন্ন শ্লোকে প্রকাশ পায়।

 

“ধনুরনুষঙ্গ রণক্ষণসঙ্গ পরিস্ফুরদঙ্গ নটৎকটকে,

কনক পিশঙ্গ পৃষৎকনিষঙ্গ রসদ্ভট শৃংগ হতাবটুকে”

এই অষ্টম শ্লোকে শিবজায়ার সোনার কাঁকন বা কঙ্কণের কথা উল্লিখিত হয়েছে।

ঝণঝণ ঝিঞ্জিমি ঝিঙ্কৃতনূপুর সিঞ্জিত মোহিত ভূতপতে,

দশম শ্লোকে বলা হয়েছে নূপুর নিক্কনে ভুতপতি মহেশকে দেবী মহামায়া সদা মুগ্ধ করে রেখেছেন । অর্থাৎ তিনি নূপুরপরিহিতা।

কটিতট পীত দুকূল বিচিত্র ময়ূখ তিরস্কৃত চন্দ্ররুচে

এবং ষোড়শ শ্লোকে তাঁর রেশমের মেখলা বা কটিবস্ত্রকে চন্দ্রকলার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।

পুরাকালে দেবীর এই অলংকার বিলাস বিষয়ে যথেষ্ট আলোকপাত করেছেন ঋষি দুর্বাসাও। তাঁর “স্বয়ম্বর পার্বতী স্তোত্রমে”-এর পঞ্চম শ্লোকে তিনি লিখেছেন খেলার সময় বালিকা পার্বতীর কানের দুল অনবরত দুলত। এবং তাঁর হাতের কাঁকনের সুমধুর কনকন শব্দ ছড়িয়ে পড়ত চারিদিকে। তাই বিবরণে কখনও’নির্ধূত কুণ্ডল’ আবার কখনও ‘নির্ধ্বনি কঙ্কণ’-এর উল্লেখ উঠে এসেছে। এমনকি চব্বিশতম শ্লোকে মায়ের কাছে আশীর্বাদ যাচঞা করতে গিয়ে ঋষি এমনও বলেছেন –

‘অক্ষম হেম কলকঙ্গদ রত্নশোভম

লাক্ষাবিলম্ জননী পাণিযুগম্‌ ত্বদীয়ম্‌’

— অর্থাৎ হে জননী তোমার সেই দু’খানি হাত আমার মাথার উপর রাখো যা বাজুবন্ধ আর বলয়ে সজ্জিত হয়ে আছে। এবং যাদের সৌন্দর্য বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে লাক্ষা প্রলেপ।

তবে এখানেই শেষ নয়। মহামায়ার এই আভরণ প্রেমের যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় ‘তন্ত্রসার’ ও ‘হরিবংশ’ গ্রন্থেও। প্রথমটিতে দেবী হলেন কাত্যায়নী। সেখানে তিনি কেয়ূর,হার, নূপুর,জটামুকুট ইত্যাদি অলঙ্কারে বিভূষিতা। এবং দ্বিতীয়টিতে তাঁকে সম্বোধিত করা হয়েছে ‘হারশোভিতসর্বাঙ্গী মুকুটোজ্জ্বলভূষণা’ রূপে। অর্থাৎ অলঙ্কারসজ্জায় তিনি চিরকালই রীতিমতো আগ্রহী ও নিখুঁত।

এ তো গেল অলঙ্কারের কথা। কিন্তু প্রসাধন? সেখানে কী!

মহাকবি কালিদাস অবশ্য তাঁর কুমারসম্ভবে এসম্পর্কে একটি সদুত্তর দিয়েছেন। সেখানে দেবী দুর্গা -সদ্যযৌবনা পার্বতী। তাঁকে বিয়ের উপযুক্ত প্রসাধনে সাজানো হচ্ছে। কবরী বিন্যাসের আগে ধূপের ধোঁওয়ায় শুকিয়ে নেওয়া হচ্ছে চুলের আর্দ্রভাব । দূর্বাযুক্ত হরিৎ বর্ণের মধুক ফুলের মালায় বাঁধা হচ্ছে কুসুমখচিত কুঞ্চিত কেশপাশ। অঙ্গ সুসজ্জিত করা হচ্ছে শ্বেত অগুরুতে। শরীরে হলুদের পীত আভা। কপালে শ্বেত ও রক্তচন্দনের লালিমা । অধরোষ্ঠ মধু প্রলেপে নির্মল। চরণযুগল আলতায় রঞ্জিত। এবং নয়নের গাঢ় অঞ্জন তাঁর রূপ শতগুণে বর্ধিত করেছে।

অতএব প্রশ্ন হল কী নেই পুরাকালের এই প্রসাধন সামগ্রীতে! অগুরু-হলুদ-চন্দন-মধু-আলতা-কুমকুম। সকলই অনবদ্য এবং তার চেয়েও অনবদ্য, অনির্বচনীয়, অনুপমেয় হল দেবীর এই সালঙ্কারা সর্ব প্রসাধন সুসজ্জিতা ভুবনমোহিনী রূপ।

এই পর্বের চূড়ান্ত পর্যায় বর্ণনা করতে গিয়ে কবি লিখছেন “এক্ষনে দেবী বারংবার দর্পণে নিজের দেহ প্রতিবিম্বিত দেখে নিশ্চল আয়তলোচনে শিবসকাশে যাওয়ার জন্য উন্মুখ হইলেন ।”

 

*****************

 

এতক্ষন দেবীর যে আভরণ-তথ্য বর্ণিত হল তা সবই প্রায় পুরাণ, কাব্য কিম্বা মহাকাব্য থেকে সংগৃহীত। তাই একথা মনে হওয়া খুব স্বাভাবিক, যে এর মধ্যে কিছু কল্পনার মিশেল থাকলেও থাকতে পারে। এত গয়না, এত প্রসাধন মা হয়তো না-ই পরতে পারেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও এবিষয়ে এক কথাই বলে।

এ অবধি গুপ্তযুগের যেক’টি (পাঁচ ছটি) দুর্গাপ্রতিমা আবিষ্কৃত হয়েছে তার প্রত্যেকটি যথেষ্ট সুসজ্জিতা। এছাড়া গুজরাটের হিম্মৎনগরের ন’মাইল পূর্বে  রোড়া গ্রামের এক আদি-মধ্যযুগীয় শিব মন্দিরেও একটি ভগ্নপ্রায় দেবীমূর্তি পাওয়া গেছে। উমা সেখানে সিংহের পিঠে বসে পরম নিশ্চিন্তে পায়ে ঘুঙুর পরছেন। যদিও রাজস্থানের যোধপুরের কাছে ওসিয়ানের হরিহর মন্দিরে অষ্টভুজা মূর্তিটির সাথে এর বেশ মিল আছে। তবে এই বিভিন্ন নিদর্শন এবং স্তোত্র থেকে এটি খুব সহজেই অনুমান করা যায় যে যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার আগে দেবী নূপুর অবশ্যই পরতেন। কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, হয় এই অলঙ্কারটি তাঁর খুব প্রিয়। নতুবা শুভ শক্তির সাথে অশুভ শক্তির এই সংগ্রাম তাঁর কাছে এক অনন্য নৃত্যাভিসার। তাই যুদ্ধের আগে এটি অত্যন্ত অপরিহার্য।

আম্বের মিউজিয়ামে পাওয়া গেছে অষ্টম-নবম শতকের একটি অষ্টভুজা দুর্গামূর্তি। এটি রাজস্থানের আবানেরি অঞ্চলের। সেখানে দেবীকে সিংহের পিঠে হাঁটু মুড়ে বসে দুহাতে ঘুঙুর বাঁধতে দেখা যায় । এবং তাঁর অন্য দুটি হাত কানের দুল পরায় ব্যস্ত। ডানহাতের একটি দিয়ে তিনি পরছেন ললাট অলংকার। আর অপরটিতে ধরে আছেন দর্পণ।

এছাড়া মধ্যপ্রদেশের বাঢ়ো গ্রামে গদরমল মন্দিরেও একটি প্রসাধনরতা দুর্গামূর্তি পাওয়া গেছে। সেখানেও দেবী প্রায় একই রকমভাবে রূপচর্চায় ব্যস্ত। নবম শতাব্দীর এই ভাস্কর্যে  শিবপত্নীর দুটি পায়ের পাতা একে অপরকে ছুঁয়ে আছে । দুটি হাত দিয়ে বড় মনোযোগ সহকারে তিনি একটি কান বালা (মাকড়ি) পরছেন। আরেকটি হাত উঠে এসেছে মাথার পিছন দিক থেকে। সেখানে ধরা আছে টিকলি এবং অপর হাতের দর্পণে যথারীতি নিজের সাজ খুঁটিয়ে নিরীক্ষণ করছেন দেবী।

তবে এই দৃশ্য কী খুবই বিরল ! দর্পণে ভেসে ওঠা প্রতিবিম্ব  কী পৌরাণিক এবং উত্তর আধুনিক কালের নারীকে কোনও একটা মধ্যবিন্দুতে একাত্ম করে দিচ্ছেনা!  কালিদাসের বর্ণনায় , ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বে , এমনকি মায়ের পুজোতেও সকল উপকরণের মধ্যে একটি প্রধান বস্তু হল দর্পণ। এটি দেবীর সর্বক্ষণের সজ্জাসঙ্গী। আর এযুগের মেয়েদের কাছে ‘ফাইনাল টাচ-আপের’ প্রধান অনুষঙ্গ- পার্স মিরর।

সুন্দরী মেয়ে। অথচ সঙ্গে আয়না নেই। ভাবা যায় নাকি আজকাল! কিন্তু প্রসাধনের এই সামগ্রীটি যে কত প্রাচীন তা অবশ্যই ভাববার বিষয়।

তবে পরিশেষে শুধু এটুকুই বলার যে, ফ্যাশন যুগের সাথে-সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বদলে যায়। কিন্তু সেই ফ্যাশনকে আত্মস্থ করে আত্মবিশ্বাসের সাথে নিজেকে পরিবেশন করার নামই হল স্টাইল ।

যুদ্ধক্ষেত্রে অমন রণসজ্জায় সজ্জিত হয়ে দশপ্রহরণ ধারণ করে সর্বালংকার বিভূষিতা কোনো দেবী যখন সুরাপাত্র হাতে তাঁর পরমতম শত্রুর বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন , “গর্জ গর্জ ক্ষণং মূঢ় মধু যাবৎ পিবাম্যহম্। ” তখন সেই চলনে-বলনে , বিভঙ্গে , যে চরম আত্মবিশ্বাস ফুটে ওঠে সেটাই হয়ে যায় তাঁর কালজয়ী স্টাইল । এবং সেই মহামুহূর্তেই বাংলার দুর্গা হয়ে ওঠেন গোটা বিশ্বের স্টাইল আইকন -যাঁর উদ্দেশ্যে শতকোটি প্রণাম করে আমরা বলি –

 

“যা দেবী সর্বভূতেষু কান্তিরূপেণ সংস্থিতা।

নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥”

Leave a Reply

Your email address will not be published.