কথায় আছে, ভ্রমণ মানুষকে বিনয়ী করে তােলে এবং জানতে পারে পৃথিবীর তুলনায় সে কত ক্ষুদ্র। তবে কথাটা আমার নয়। বিশ্ব বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব গুস্তাভ ফ্লবেয়ারের। আর আমার কাছে সেই কথাটাই হল যখন মন চাইবে বেরিয়ে পড়াে। আর তাই সমস্ত ব্যস্ততাকে দূরে সরিয়ে কলকাতা থেকে ৩০০ কিমির মধ্যে গালুডি যাওয়ার প্ল্যান করে ফেলি। একা একা কোথাও যেতে ভালাে লাগে না। তাই ছােটবেলার বন্ধুদের রাজি করালাম অনেক কষ্টে। কারণ আমার সময় হলেও তাদের তাে অনেক কাজ।
সে যাই হােক, রইল ঝােলা, চলল ভােলা এবার অন্যকিছুর খোঁজে। গােছগাছের ব্যাপারে ভীষণ রকম খামখেয়ালি আমি, কিন্তু যেখানে দু’চাকা আছে। সেখানে কোনও কম্প্রোমাইজ নয়। আর তাই বেরিয়ে পরার আগে একবার গাড়ির সমস্ত পার্টস থেকে শুরু করে তেল সবকিছু দেখে নিলাম। একটু তাড়াতাড়ি বেরােলে যাতে পৌঁছে যাই গন্তব্যে, তাই ৩টের অ্যালার্ম দিয়ে রাখলাম। বাকিদেরও জানিয়ে রাখলাম ঠিক এই সময়ে চলে আসতে।
ভাের ৩টে ৩০। শহর কলকাতার ঘুম ভাঙেনি এখনও। পাগল চৈতি হাওয়া হালকা বয়ে যাচ্ছে গলির মােড়ে, ঘুমন্ত বাড়িগুলাের ওপর। আমরা তিন বন্ধু মাথায় হেলমেট চাপিয়ে রওনা হলাম অদেখা ঝাড়গ্রামের দিকে। সৌম্য, বিকি আর আমি বাইক স্টার্ট করে নাগের বাজার থেকে সােজা টেনে বেরিয়ে গেলাম বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে। টানা ২ ঘন্টা নন–স্টপ রাইড করে প্রথম বিরতি নিলাম কোলাঘাটে। কোলাঘাটে ব্রেকফাস্ট করতে করতে দেখি আমাদের মতাে আরও বেশ কয়েকটি গ্রুপ বাইক নিয়ে বেরিয়েছে। বিকি তাদের সঙ্গে গিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে নিল। এদিকে আমি আমার বাইক চেক করে নিলাম। আফটার অল আমার প্রিয় সঙ্গী সে। চা–পর্ব মিটিয়ে রওনা হলাম। ও হ্যাঁ এখানে একটু বলি, নিজের সেফটির জন্যে সবসময় রাইডিং জ্যাকেট, গ্লাভস, রাইডিং প্যান্ট, হাই অ্যাঙ্কেল শু কিন্তু মাস্ট। কোলাঘাট থেকে বেরিয়ে পাশকুঁড়া, তারপর খড়গপুর। দুটো রাস্তা আছে যাওয়ার। একটা রুট চলে গেছে বেলপাহাড়ি, ঝিলিমিলি, বান্দুয়ান-এর সুন্দর প্রকৃতির ভেতর দিয়ে ৩০০ কিমি। আর একটা সােজা রুট হলাে ঝাড়গ্রাম হয়ে ২৬২ কিমি–র। এবার আপনাকে ডিসাইড করতে হবে কোন পথে যাবেন। খড়গপুর থেকে আমরা বেলপাহাড়ির রুটটাই নিলাম। এতে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে। আমাদের পিছু পিছু আরও একটা গ্রুপ চলতে শুরু করল। ভালােই হল, এতে অনেকের সঙ্গ মিলবে, আর বেশ মজাও হবে। এবার আস্তে আস্তে রাস্তার পাশের দৃশ্য বদলাতে। শুরু করল। কংক্রিটের জঙ্গল ছেড়ে প্রকৃতির ভেতর একটা আলাদা শান্তি আছে।
সুবর্ণরেখার তীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘাটশিলার পাথুরে ভূমিতে, গালুডির রুক্ষ প্রান্তর। বাইকের দু চাকায় ভর করে আমরা যেন উড়ছি। রাস্তাও বেশ ভালাে এখানে। শুনেছি এখানে সুর্যাস্তের রক্তিম সূর্য সুবর্ণরেখার জলে লাল আবির গুলে দেয়… পাথরের বুকে রঙের জলছবি এঁকে দেয়। যাঁরা উইকেন্ডে একটু শান্তিতে কাটাতে চান, তারা অনায়াসেই চলে আসতে পারেন গালুডিতে।
আমরা হােটেলে পৌঁছই বেলা ১২টায়। এর কারণ হলাে মাঝে মাঝে রাস্তার মাঝখানে বাইক থামিয়ে অরণ্যের মাদকতায় হারিয়ে যাওয়া। এখানে আশেপাশে গড়ে ওঠা বিক্ষিপ্ত জনবসতির সবাই আদিবাসী। মূলত সাঁওতাল, খেরিয়া, মুন্ডা, শবরদের বাসভূমি। আর তাদের জীবিকা হল কেন্দুপাতা, শালপাতা সংগ্রহ আর পশুচারণ। এই জঙ্গলে রাত্রিবাস করতে বেশ এক অ্যাডভেঞ্চারই হবে। আমরা গালুডি রিসর্টে উঠেছিলাম। বেশ ভালাে রিসর্টটা। খাবারও বেশ ভালােই। এখানে দুপুরের খাবারটা খেয়ে, সামান্য একটু রেস্ট নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় আসার সময় যে বাইকার গ্রুপটার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। দেখলাম তারাও পাশের রিসর্টে উঠেছে। রিসর্ট থেকে বেরিয়ে সুবর্ণরেখার তীরে চলে এলাম আমরা। ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভূম ডিস্ট্রিক্ট–এ গালুডি ছােট্ট একটা শহর। এখানকার মূল আকর্ষণই হলাে দুই পাহাড়ের মধ্যে সূবর্ণরেখার ভাগ হয়ে যাওয়া। সােনার সুতাের মতাে যেন নিজেকে পাহাড়, গাছপালা, প্রকৃতি দিয়ে ঘিরে রেখেছে। গালুডি থেকে ঘাটশিলা ৫ কিমি প্রায়।
আবহাওয়া মুহুর্তে বদলে যায় এখানে। দুপুরে বেশ গরমই করছিল। এখন হালকা হাওয়ার সঙ্গে মেঘের দল উড়ে আসছে কোথাও থেকে। কোনও তাড়াহুড়াে নেই তাদের। আমাদের মতােই আমেজ নিচ্ছে। মহুলিয়া বাজারে গিয়ে কিছু খাবার দাবার নিয়ে আবার আমরা গালুডি এক্সপ্লোর করতে বেরােলাম। রাতে রিসর্টে ফিরে আরও একপ্রস্থ খাওয়া দাওয়া। সৌম্য বলে উঠল, পাশেই সূবর্ণরেখার ধারে শ্মশ্মান আছে, চল ঘুরে আসি। সঙ্গে নাইট সাফারিও হয়ে যাবে। সেই মতাে হােটেলের একজনকে নিয়ে আমরা আবার বেরােলাম। দিনের সচলতা যে এরকম নিস্তব্ধতায় পরিণত হতে পারে। ধারণা করতে পারিনি আমরা। সড়কি বেছানাে রাস্তা ছেড়ে আমরা জঙ্গলের রাস্তায় নদীর দিকে এগােতে শুরু করলাম। পাতা ঝরে পড়ার শব্দেও চমকে ওঠা। পায়ের চাপে পাতার মড়মড় করে শব্দ যেন কতদূর ছড়িয়ে পড়ছে। শ্মশানে পৌঁছে কিছুক্ষণ নীরবতা গ্রাস করল আমাদের। গতরাতে রিসর্টে ফিরে সটান ঘুম। সকালে এখান থেকে বুরুডি’তে যাব। সেখানে না গেলেই নয়। বুরুডি ড্যাম যাওয়ার জন্যে আমরা রিসর্ট থেকে বেরিয়ে এনএইচ ১৮ ধরলাম। গালুডি থেকে দূরত্ব ২০ কিমি। ১০ কিমি যাওয়ার পর শুরু হলাে রাস্তার বাঁক। আঁকা বাঁকা রাস্তা পেরিয়ে গারুডি ড্যাম। কিছুটা মেঘলা আকাশ আজ। সূর্য কিছুটা ক্লান্ত। কিন্তু তার পাহাড়, ড্যাম, জঙ্গলের উপর সােনালী স্বপ্ন ছড়িয়ে দেবে বলে আরও একবার ঝলমলিয়ে উঠছে। আমরা তিন বন্ধু বসে আছি ড্যামের পাশে। যেন অনন্তকাল ধরে এই চেয়ে থাকা। এখান থেকে ধারাগিরি ফলস–এ যাব। অনেক শুনেছি তার কথা। শাল, শিমুলের ছায়া পেড়িয়ে এগিয়ে চললাম। রাস্তার একপাশে শ্লেট পাথরের পাহাড়ের কিছু অংশ, আর একপাশে গভীর খাদ। এই দৃশ্য দেখে না থামলেই নয়।
দু‘চাকার এই সুবিধে। ছবি তােলার জন্যে বিকি তার ক্যামেরা বের করল। কিছুক্ষণ ছবি পর্ব চলার পর, সেখান থেকে এগােতেই একটু খারাপ রাস্তায় পড়লাম। অবশ্য তারপর রাস্তা বেশ ভালাে। পাহাড়ী পাথুড়ে জঙ্গলের ভেতর ধারাগিরি ঝর্না। ভরা বর্ষায় এর তেজ থাকে বেশ। কিন্তু এখন একটু চুপচাপ। শান্ত শীতল ধারা নিয়ে বয়ে চলেছে সে। সন্ধে হয়ে আসছে এবার। ফিরে যাওয়া রিসর্টে।। পরদিন কলকাতায় ফেরার পথে আমরা ঘাটশিলার দিকে রওনা দিলাম। কলকাতা রাচী সড়কের ধারেই ফুলডুংরি পাহাড়। এক মায়াবী টিলা। এখানেই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘চাঁদের পাহাড়’, ‘আরণ্যক’, ‘দেবযান’সহ আরাে অনেক কালজয়ী উপন্যাস লিখেছেন।
ফেরার পথে দেখে নেওয়াই যায় প্রকৃতির এই সৃষ্টিকে। ব্যাক টু কলকাতা। এক বুক প্রকৃতির শীতলতার ছোঁয়া তখন আমাদের মনে প্রাণে। অল্প ছুটির জন্য বেস্ট জায়গা গালুডি। হাইওয়ে ধরে ফিরতে ফিরতে মনে হচ্ছিল, ‘সত্যিই আমরা প্রকৃতির কাছে কত ছােট। আপনার মনের কুঠুরিতে স্মৃতিদের জায়গা করে দিতে উইকেন্ডে ঘুরে আসতেই পারেন ঘাটশিলা—গালুডি-বুরুডি-ধারাগিরি।
কোথায় থাকবেন ঃ– গালুডি রিসর্ট। রজনিগন্ধা গেস্ট হাউস, বনবীথি গেস্ট হাউস।