সম্পর্কের সুতো || অজিত ঘোষ

প্যাঁচ পেচে গরমের হাত থেকে বাঁচতে জানলার পাশের চেয়ারে বসেছিল বিভাস ৷ কিন্তু প্রকৃতি বিরূপ ৷ বিন্দুমাত্র হাওয়ার ছোঁয়া পর্যন্ত নেই ৷ বিরক্তিতে মুখ ঘুরিয়ে নেবার মুহুর্তে জানলার গ্রীলের ফোঁকর ভেদ করে শিমুল গাছের ডালে একটি মিশকালো রঙের পাখি বাসা সমেত নজরে আসে তার ৷ প্রথমে দুটো ছোট্ট ছানার চিঁ চিঁ শব্দ কানে আসে পরে মা পাখিটি ৷ বাবা পাখিও হতে পারে ৷ তবে পাখি সংসারের নিয়ম অনুসারে মা পাখিই হবে ৷ বাবা পাখি সচরাচর বাসা বাধে না , ছানাদের লালন পালন করার দায়িত্ব নিতেও নারাজ ৷ সে সব দায়িত্ব মা পাখিকেই নিতে হয় ৷ বাবা পাখি ভবঘুরে ৷ নির্ঝঞ্ঝাট প্রকৃতির ৷

চিঁ চিঁ শব্দে খিদের জাগান দেওয়া ছানাদের মুখে মা পাখিটি নিজের ঠোঁটে করে বয়ে আনা খাবার পুরে দিচ্ছে ৷ খাবার উল্লাসে ছানারা ঘিরে ধরেছে মাকে ৷ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যগুলির অন্যতম আশ্চর্য্য দৃশ্য ৷ এতটুকু পাখির মনে কোন এক অলৌকিক মায়ায় জন্ম নিয়েছে মাতৃস্নেহ ! সে নিজে না খেয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেছে সন্তানের উদরপূর্তির ৷ দৃশ্যটি দেখে বিভাসের মনে হল সত্যি সমস্ত জীব জগতেই ঈশ্বর রয়েছেন ৷ সন্তানের খাবার জোগারের আর্তি তিনি ঠিক শোনেন ৷ কালো রঙের মা পাখিটির মধ্য দিয়ে ছানাদের খাবার ঈশ্বরই জুগিয়ে চলেছেন ৷

পাশের ঘর থেকে আঁছড়ে পরা বাসনের শব্দ ভেসে এলো ৷ দুপুর গড়িয়েছে বেলা ৷ পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছে রিমা ৷ বাসনের শব্দ আসা মানে ঘুম ভেঙেছে ৷ রোজকার ঘটনা ৷ রিমা মুখে কোন কথা বলে না ৷ মুখো মুখি চেয়ে থাকে না ৷ মুখ ঘুরিয়ে থাকে ৷ সয়ে গেছে বিভাসের ৷ শান্ত গতিতে জানালাটা বন্ধ করে পাশের ঘরের দিকে পা বাড়ালো ৷

স্টিলের গ্লাস পরে আছে মেঝেতে ৷ এখনও তার মৃদু শব্দের অনুরণন ছড়িয়ে ঘরময় ৷ বিভাস গ্লাসটি উঠিয়ে রাখলো রিমার হাতের কাছের স্তুপাকৃতি বাসনের ঝুরিতে ৷ এমনটাই এ বাড়ির অলিখিত নিয়ম ৷ ছোট তিনটি চাকাওয়ালা বাসনের ঝুরি সবসময় থাকে রিমার হাতের নাগালে ৷ ছোট বড়ো প্রয়োজনের ইঙ্গিত বহন করে বিভিন্ন আকৃতির বাসন ৷ এসময় গ্লাস ছুরেছে মানে তার বিকেলের চা চাই ৷ দু চার মিনিট দেরি হলে কোন আপত্তি নেই ৷ আপত্তি থাকলে রিমা এই মুহুর্তে আরেকটি গ্লাস ছুড়ে ফেলত মেঝেতে ৷ রিমার এমন অমানুষিক আচরনে প্রথম প্রথম রাগ করলেও এখন সে পথ থেকে সরে এসেছে বিভাস ৷ যে গাছ আঁছড়ে পরা ঝরের গতিকে সামলে নিজের অবস্থানে অবিচল থাকতে পারে সে গাছ তাচ্ছিল্যের নয় , করুনার পাত্র ৷ সেই করুনার দাবিদার রিমার আচরনে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তোলা ছেড়ে দিয়েছে বিভাস ৷ সহনশীল মাটির মতো মেনে নিয়েছে সবকিছু ৷ মেনে নেওয়াই পরিণতর পরিচয় ৷ যে মেনে নেওয়াকে হার স্বীকার মনে করে তার পক্ষে আর যাই সম্ভব হোক না কেন সংসার অসম্ভব ৷ সংসারের কিছু নিজস্বতা রয়েছে ৷ পরস্পরকে বুঝে সাহায্যের ,সহানুভুতির হাত বাড়িয়ে দেওয়াই সংসারের নিয়ম ৷ রিমার ছুড়ে ফেলা এক একটি বাসনকে বিভাস ভেবে নিয়েছে সুতো ৷ সম্পর্কের সুতো ৷

চা তৈরীর প্রস্তুতি নিতে গিয়ে বিভাস দেখল চিনির কৌটো প্রায় ফাঁকা ৷ দুধের প্যাকেটও শেষ হয়ে গেছে ৷ গতকাল কাজের মেয়েটি বলছিলো দাদা ফেরার পথে চিনি আর দুধ নিয়ে এসো ৷ তাল মিলিয়ে হ্যাঁ বলেছিলো , কাজের কাজ হয় নি ৷ আজ রবিবার ৷ ছুটির দিন ৷ কাজের মেয়েটি আসেনি ৷ সপ্তাহের বাকি ছ‘দিন সে আসে তার নির্দিষ্ট সময়ে ৷ সকাল আটটা থেকে দশটা ৷ বিকেল চারটে থেকে সাতটা ৷ ঘরদোর পরিস্কারের সঙ্গে সকাল বিকেলের চা সেই করে ৷ রান্না করে না ৷ রান্না রিমাও করে না ৷ এ বাড়িতে রান্না হয় না ৷ দু বেলা খাবার আসে একটি হোম ডেলিভারি সংস্থা থেকে ৷ রিমার কোন কাজ নেই ৷ অসারের মতো পরে থাকে ৷ রিমার মনের কাছাকাছি যেতে বিভাস অফিস থেকে ফিরে রিমার ঘরের সোফায় নিজেকে ধপাস করে এলিয়ে দিয়ে বলে , সারাদিন তুমি কত কাজ করো রিমা ৷ কোনদিনই সে প্রশংসার  কোন উত্তর না পেয়ে নিঝুম ঘরে অনেকটা সময় কাটিয়ে বিভাস নিজের ঘরে যায় ৷ দুজনের ঘর আলাদা ৷ বিছানা আলাদা ৷ বেঁচে থাকার ধরন আলাদা কেবল বন্ধন এক সুতোয় বাঁধা ৷

খোলা জানালা দিয়ে গলি রাস্তার ওপারে জগদীশ কাকুর বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে রিমা ৷ জগদীশ কাকু রিটায়ার্ড পার্সন ৷ বিশাল আকৃতির বাড়িতে স্বামী স্ত্রী দুজন মাত্র মানুষ ৷ দেশের বাইরে থাকা দুই ছেলে বড়ো অফিসার ৷ ভারত সরকার নাকি ওদের যোগ্যতা অনুযায়ী বেতন দিতে ব্যর্থ ৷ সেজন্য দু ভাই দৌড়েছে ব্রিটেনে ৷ বৃদ্ধ বাবা মা কে একলা ফেলে ৷ এখন এমন ট্রাডিশন খুব চলছে ৷ সম্পর্কের মায়ার চেয়ে কেরিয়ারের টান বড়ো ৷ দিন পনেরো হল ঐ বাড়িতে ভারাটে এসেছে ৷ সম্ভবত মুখ গম্ভীর করে পরে থাকা ঘরগুলো একটু যত্ন আত্তি পেয়ে খুশির হাওয়ায় খেলবে ৷ সেই কারনেই জগদীশ কাকু নীচুতলায় গ্যারেজের পাশের দুটো রুম ভাড়া দিয়েছেন ৷

ভাড়াটে ফ্যামিলির একটি বছর তিনেকের বাচ্চা আছে ৷ প্রায় সময় বাচ্চাটি জানলার কাছের বিছানায় উঠে বসে থাকে ৷ দুষ্টুমি করে ৷ বিছানায় লাফায় ৷ আধো আধো স্বরে ইংরেজি পোয়েম আওড়ায় ৷ গলির পথে চলা মানুষদের দলা পাকানো কাগজের ঢিল ছুড়ে মেরে খিলখিলিয়ে হাসে ৷ মাএর কাছে ধমক খায় ৷ বাচ্চাটির বাবা ভদ্রলোক মনে হয় চাকরি করেন ৷ সকাল দশটা নাগাদ বেড়িয়ে যান ৷ সন্ধ্যে সন্ধ্যে ফিরতে দেখা য়ায় ৷

ঐ বাচ্চাটির দৌলতে জন্মান্ধ জানালাটি দৃষ্টি পেয়েছে ৷ আগে সারাদিন গুমোট ঘরে গুমরে বসে থেকেও রিমা জানলাটা খুলত না ৷ বাচ্চাটি আসার পর থেকে খুলছে৷ এখন সারাদিন প্রায় খোলাই থাকে ৷ এমনকি অনেক রাত পর্যন্তও ৷ যতক্ষন না বাচ্চাটি ঘুমোয় ৷ বাচ্চাটির মার চোখে অনেক সময় চোখ পরে যায় রিমার ৷ ঐ পর্যন্তই ৷ সন্তানের মঙ্গল কামনায় বাচ্চাটির মা চেষ্টা করে না রিমার সাথে কথা বলার ৷ পাড়ার হাওয়ায় রিমা সম্পর্কে অনেক রকম কথা ওড়ে ৷ দীর্ঘ্যদিন সন্তান না হওয়া , কারও সাথে প্রয়োজন বিশেষেও কথা না বলা , এ বাড়িতে কোন আত্মীয়র না আসাতে পাড়ার মানুষের মনে রিমা সম্পর্কে অশোভন কথার উদ্রেক হওয়াই স্বাভাবিক ৷ সেসব কথার সত্যতা বিচার করে নিজের সন্তানকে রিমার সাথে মিশতে দেবার মানষিকতা ঐ বাচ্চাটির মায়ের নেই ৷ থাকবেই বা কি করে এইতো দিনপনেরো হল পাড়ায় এসেছে ৷ তাছাড়া ভরা কলসির সাথে শূন্য কলসির পার্থক্য জন্ম জন্মান্তরের ৷ ভরা কলসির পক্ষে কখনই অনুভব করা সম্ভব নয় শূন্য কলসির মর্মব্যাথা ৷

পরিপাটি সেজে বাচ্চাটি জানলার গ্রীলের ফাঁক গলিয়ে তার খরগোশের ন্যায় ছোট্ট দুটো হাত দুলিয়ে টা টা জানাতে রিমার মুখে হাসি ফুটলো ৷ সে হাসির দৃশ্য বেশিক্ষন স্থায়ী হয় না ৷ কোথা থেকে বাচ্চাটির মা এসে “চলো বাবা ” বলে বাচ্চাটিকে কোলে নিয়েই সশব্দে জানালাটা বন্ধ করে দিতে বদলে গেল দৃশ্য ৷ যেন চলন্ত শো তে পর্দা পরে অন্ধকার গ্রাস করল মঞ্চ ৷ বাচ্চাটির মার সাজগোজ দেখে মনে হল ওরা কোথাও যাচ্ছে ৷ বছরের অন্যান্য রবিবারের চেয়ে পুজোর রবিবারগুলো অন্য মাত্রা পেয়ে থাকে ৷ অনেক ফ্যামিলিই পুজোর কেনাকাটায় যায় ৷ ওরাও বুঝি গেল ৷ জানলাটা বন্ধ হতে পুজোর উজ্জল রোদ্দুরের মতো হারিয়ে গেল রিমার হাসি ৷

“চা” ছোট্ট শব্দে রিমার টেবিলে চায়ের কাপ রেখে নিজেরটা নিয়ে বিভাস জানলার পাশের চেয়ারে গা এলিয়ে দিল ৷ চায়ে চুমুক দিয়েই বুঝল চিনি কম হয়েছে ৷ তবে তার চলে যাবে, রিমার চলবে না ৷ বিভাস ভাবছে এই বুঝি বাসন ছুড়ে ফেলে রাগ প্রকাশ করবে রিমা ৷ ভয়ে ভয়ে দু চুমুকে চা শেষ করে সিগারেট ধরাল ৷

শিমুল গাছে মা পাখিটি সুর করে গান গাইছে ৷ খুব অস্পষ্ট সুর , খারাপ লাগছে না শুনতে ৷ সন্তানের পেট ভরানোর আনন্দের সে সুর ৷ বাচ্চা দুটোর টুকটুকে হলুদ ঠোঁট উঁকি মারছে মা পাখির ছড়িয়ে বসা ডানার ভেতর থেকে ৷ মা হতে পারলে এমন সুখের গান রিমাও গাইতো ৷ অন্ধকার ঘরে জীবনটাকে এমন বিষিয়ে তুলতো না ৷ সারাক্ষন হাসিখুশি থাকতো ৷ পাখি হোক বা মানুষ মা জাতির সুখের প্রকাশ সন্তানের মুখ দর্শনে ৷

দুই

আজও স্পষ্ট সে দিন ৷ বিয়ের দু সপ্তাহ পরে সেদিনই প্রথম ৷ চোখের সামনে নতুন বউ ঘুরঘুর করছে ৷ ধরা দিচ্ছে না ৷ দু সপ্তাহযে কি নিদারুন যন্ত্রনায় কেটেছে বলার ভাষা ছিল না বিভাসের ৷ নানা অজুহাত রিমার ৷ ছোঁওয়াই মুশকিল ৷ সেদিন কাছে পেয়েছে ৷ কাছে পেয়েছে ঠিক বলা যায় না ৷ রিমা নিজের ইচ্ছেতে ধরা দেয় নি ৷ আয়নার সামনে দারিয়ে কোমর পর্যন্ত ঝুলে থাকা চুলে চিরুনি চালানো রিমার মসৃন মেঝের মতো চকচকে কোমর পেছন থেকে জাপটে ধরে বিভাস ৷ জোর খাটিয়ে রিমার ঘাড়ে , গালে অনবরত চুমু খেতে খেতে এনে ফেলে তখনও ফুলসজ্জার গন্ধে মাতোয়ারা বিছানায় ৷ রিমার সমস্ত বাধাকে অতিক্রম করে সরিয়ে ফেলে বুকের আঁচল ৷ শরীরি মাদকতায় ভরপুর বিভাস রিমার তুষারধবল উন্নত পাহারের গিরিখাদে হারিয়ে যাবার মুহুর্তে হিসহিসিয়ে রিমা বলে , “ঘরে লাইট জ্বলছে যে ?”

“জ্বলুক না ৷ প্রথম সমুদ্র যাত্রার সাক্ষী হয়ে থাক ৷ জ্বলুক ৷“

“না“

“কেন ? তোমার কি লজ্জা করছে ?

“হ্যাঁ “

“প্রথম প্রথম অমন লজ্জা করে ৷ পরে সব ঠিক হয়ে যায় ৷“

“রাগ হচ্ছে ৷ ঘরে দু দুটো লাইট জ্বলছে ৷ এত আলোতে তুমি এসব … ৷ তোমার লজ্জা করছে না ?”

বিভাস ততক্ষনে পাহাড় ভেঙে ভঙে গিরিখাদের নীচে নেমে অগ্রসর হয়ে চলেছে গিরিখাদ বেয়ে জলের রেখা যে পথে চলেছে সাগরের দিকে ৷ সাগরে বিলিন হয়ে যাওয়াই তার লক্ষ্য ৷ এমন মুহুর্তে রিমার ঠোটের কাছে মুখ নিয়ে যেতে বাধা পায় সে ৷ হাল্কা নয় ৷ জোড়োলো বাধা ৷ অনেকটা ঘরে জ্বলা লাইট দুটোর জোড়ালো আলোর সমান ৷ সেই জোড়ালো বাধায় হাল ছেড়ে দেওয়া বিভাস দেখল রিমার মুখে অপরাধ বোধের ছায়া স্পষ্ট ৷ রাগে না লজ্জায় বলা মুশকিল ৷ রিমা নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে বসল ৷ দ্রুত শাড়ি , ব্লাউজ ঠিকঠাক করে , ঘাড়ের উপর ছড়িয়ে পরা হাতখোঁপা পুনরায় বেধে ফেলল ৷ বিভাসের অপ্রাপ্তির তোয়াক্কা না করে গিয়ে দাড়ালো আয়নার সামনে ৷ চোখের নিমেশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলির পারস্পারিকতায় কোন সম্পর্কের ছোয়া নেই ৷ অথচ রিমা তার বিবাহিত স্ত্রী ৷ সেদিনের ঘটনাকে নিছক রিমার ছেলেমানুষি লজ্জাবোধ ভেবে বার বার কাছে টেনে নেবার , স্বামীত্বের অধিকারে শরীরি সম্পর্ক স্থাপন করতে চেষ্টা করেছে ৷ আত্মহত্যার চিঠি পড়ে যেমন আত্মহত্যার মূল কারন জানা যায় না তেমনই জীবনের সমস্ত চেষ্টার কথা মুখ ফুটে বলা যায় না , লেখা যায় না ৷ বিভাস প্রতিবারই অসফল হয়েছে ৷ রাগ , জেদ , ঘৃনার পারদ সমুদ্রের ফেনার মতো ভাসতে ভাসতে সমুদ্রেই লীন হয়েছে ৷

স্কুল জীবনের বন্ধু অরিন্দম হাসপাতালের গেটকিপার ৷ মেধাবী ছেলেটির সুন্দর সুন্দর স্বপ্নগুলো এই শহরের ভীড়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে ৷ জীবন বইছে ভিন্ন খাতে ৷ অরিন্দমের কথায় , মদ খেয়ে বাড়ি ফিরলে সাজানো ট্রফিরা সব সপাটে চড় কষায় গালে ৷ গুমরে কাঁদি ৷ ঐ কান্নাতেই সান্তনা লুকিয়ে ৷ কাকে দোষ দেবো বল ? দোষ দিয়ে লাভই বা কি ? মেধাতো কাগজের সার্টিফিকেটে নম্বর ছাড়া অন্য কিছু নয় ৷ মেনে নিতে হয় ৷ মেনে নেওয়াটাই সিস্টেম ৷

সব কথা খুলে বলার মতো একজনই বন্ধু বিভাসের , অরিন্দম ৷ বিয়ের মাসছয়েক চেষ্টার পরে অসফল বিভাস বন্ধুর শরনাপন্ন হয় ৷ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনে অরিন্দম চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি ৷ হাসপাতালে গেট কিপারের কাজ করা অরিন্দমের পরিচয় ডাক্তারি দুনিয়ায় খুব খারাপ না ৷ মেধাবি ছাত্র ছিলো বলে অনেকে তাকে সমীহ করে ৷ ঐ সমীহটুকুই প্রাপ্তি একশোতে তিরানব্বই পাওয়া অরিন্দমের ৷ একের পর এক নামকরা গাইনোর দরজায় টোকা দিয়েছে ৷ কোথাও বিভাস রিমা দুজনেই সঙ্গে গেছে তার , কোথাও বিভাস একা ৷ কাজ হয়েছে না হয়নি বলা মুশকিল ৷ কারন বেশিরভাগ ডাক্তারের কথায় , মেডিক্যাল টেস্টে রিমার হিস্টিরিয়া ধরা পরেছে ৷ এমন রোগে শরীরি সম্পর্ক , মা হওয়াতো দুরের কথা অনেকের ক্ষেত্রে স্বামীকে বা যে কোন পুরুষকে মেনে নেওয়াই অসম্ভব ৷ ভেঙে পরেছিল বিভাস ৷ শেষে রিমাকে অরিন্দমের সাজেশনে নিয়ে যাওয়া হয় মনোরোগ বিশারদের কাছে ৷ রিমাকে সে তো আর অবহেলা করতে পারে না ৷ বিবাহিত স্ত্রী ৷ সাত পাকের সুতোর বন্ধন ৷ যারা পারে তাদের নিয়ে উত্তাল নারীবাদীর দল ৷ বিভাস যে নিজের সমস্ত চাওয়া পাওয়াকে জলাঞ্জলি দিয়ে হিস্টিরিয়া পেশেন্ট স্ত্রীর সুস্থ হবার আশায় দিন গুনছে সেজন্য কোন নারীবাদী বা মহিলা সমিতি এসে তাকে ধন্যবাদ দেবার প্রয়োজন মনে করেনি ৷ শরীর ও মনের দিক থেকে বিকারগ্রস্থ রিমা ৷ হিস্টিরিয়া রোগের অনেকগুলি দিকের মধ্যে সাইকো ফিজিকো একটি অন্যতম দিক ৷ এমন রোগে আক্রান্তরা কাউকে সহ্য করতে পারে না ৷ যতই কাছের মানুষ হোক না কেন ৷ কথায় কথায় রাগের সপ্তমে পৌছে সেন্সলেস হয়ে পরা এ রোগের লক্ষন ৷ সেদিন দীর্ঘ্যক্ষন ধরে রিমার কাউন্সেলিং চলাার পরে আশার আলো ফোটে ৷ মনোবিদদের কথায় বিভাস জানতে পারে হিস্টিরিয়া রোগের বহু প্রকার ভেদ আছে ৷ এটি একটি মানষিক রোগ হওয়াতে কোন ওষুধেই এ রোগের প্রতিকার সম্ভব নয় ৷ অপেক্ষা করতে হবে সময়ের ৷ এমন রোগিরা পুরুষকে ঘৃনার চোখে যেমন দেখে তেমনই ভয় পায় সম্ভোগে ৷ তবে এদের মা হবার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না ৷ অন্য যে কোন বাচ্চার প্রতি বাৎসল্য প্রেম অনুভব করা , সে বাচ্চার দিক থেকে আঘাত এলে তবেই সে আঘাত ওষুধের কাজ করতে পারে ৷ যদিও প্রেগন্যান্সি থেকে বাচ্চা ডেলিভারি পর্যন্ত সময় প্রচন্ড ঝক্কির ৷ সে সমস্ত ঝক্কি সামলে এমন রোগি মা হয়েছে তার উদাহরনও প্রচুর আছে ৷ অতএব অপেক্ষা করুন ৷ যত্ন নিন ৷ সহানুভূতির চোখে স্ত্রীকে দেখুন ৷ ফল পেতে পাবেন ৷ ফল পেলে

ফোনে জানিয়ে দেবেন ৷ খুশি হবো ৷

পুনরায় সিগারেট ধরাল বিভাস ৷ আগে খুব হিসেব করে সিগারেট খেত ৷ এখন হিসেব রাখে না ৷ কিছুক্ষনের মধ্যেই সন্ধ্যে নামবে ৷ সকালে ধীমান ফোন করে রবিবারের আড্ডায় যাবার আমন্ত্রণ জানিয়েছে ৷ বন্ধুদের আড্ডায় আজকাল যেতে ইচ্ছে করে না ৷ ‘শুকনো নদীর তীরে বসে আছি একা‘ , ‘বালি ভিজবে কবে‘ – বন্ধুদের আড্ডায় এই জাতীয় রসিকতা উপহাসের মাত্রা পায় ৷ শুনতে ইচ্ছে করে না ৷ যাবে না বিভাস ৷

তিন

গ্লাস আছড়ে পরার শব্দে সজাগ হল বিভাস ৷ সময় মিলছে না , এসময়তো চা এর প্রয়োজন হয় না রিমার ৷ তাছাড়া কিছুক্ষন আগের চা তার পছন্দ না হলে রাগ উগরে দিতে এত সময় নেবারও কথা নয় ৷ ভাবনার মাঝেই ঝন ঝন শব্দে কেপে উঠল বাড়ি ৷ ঠিক যেন কাঁচের ঘর ভাঙার শব্দ ৷ লম্বা টান মেরে সিগারেটের শেষ অংশ ছুড়ে ফেলে প্রায় দৌড়ে গিয়ে রিমার ঘরে , দেখে ঝুরির সমস্ত বাসন মেঝেতে ছড়িয়ে আছে ৷ এমনটা এর আগে কোনদিন হয়নি , সমস্ত বাসন ছুড়ে ফেলে রিমা কি বোঝাতে চাইছে বোধগম্য হল না ৷ কিন্তু বিরক্তিতে মনটা বিষিয়ে উঠল ৷ রাগে এই মুহুর্তে রিমাকে অত্যাচারী মনে হচ্ছে ৷ ঘুরে ফিরে  নিজেকে শেষ করে দেবার ইচ্ছে মনের মাঝে দানা বাধতে শুরু করেছে ৷ এমন ইচ্ছে হলে বরাবর মাথা নীচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে বিভাস ৷ অনেকক্ষন সেভাবে থাকার পরে যখন একটু একটু করে রাগের পারদ গলতে শুরু করেছে , সে সময় চিৎকার করে উঠল রিমা , “সমস্ত দোষ আমার , তুমি কেন মাথা নীচু করে আছো ?”

হঠাৎ বিদ্যুতের চমকে মাথা তুলল বিভাস ৷ রিমা যে কখন তার কাছ ঘেষে এসে দাড়িয়েছে , সে লক্ষ্য করেনি ৷ কিছু বুঝে ওঠার আগেই শক্ত বাঁধনে রিমা তাকে জড়িয়ে ধরে ৷

” আমি এত অন্যায় করে চলেছি আর তুমি তা মুখ বুজে সহ্য করেছো কেন ? ভালোবাসতে শেখোনি ? ভালোবাসাতে , ভালোবাসার জনকে আঘাত দিতে জানতে হয় ৷ তুমি কেন আমার সমস্ত আঘাতকে মাথা পেতে মেনে নিয়েছো ? কেন তুমি আঘাত করোনি ? কেন বলো ? বলো ? বলো …৷“

এমন এক প্রশ্নাত্বক সময়ের অপেক্ষায় ছিল বিভাস ৷ এমন হাজারো কুন্ডলিকৃত প্রশ্নেরা একসময় বদ্ধ ঘরের চার দেওয়ালে বাধা পেয়ে মাটিতে আছড়ে পরলেই রিমা পেয়ে যাবে তার প্রশ্নের সমস্ত উত্তর ৷ সময়টা সহজ না কঠিন বলা মুশকিল হলেও এই ভর সন্ধ্যেতে দিনের আলোর আভা ফুটে উঠলো বিভাসের চোখে ৷ মনে মনে সে আজকের সন্ধ্যের মুহুর্তকে অজস্র ধন্যবাদ দিয়ে ঠায় চেয়ে রইল রিমার দিকে ৷

শব্দ করে কাঁদছে রিমা ৷ বৃষ্টির জলে ফুলে ওঠা নদীর মতো বানভাসি সে কান্নার স্রোত ৷    “এটা কোন সংসার হল ? আনন্দ নেই , দুঃখ নেই ? দুজন এক ছাদের নীচে থেকেও দুজন দুজনের মনের কাছাকাছি নেই ৷ এমনকি এবাড়িতে তৃতীয় জনের কোন সম্তাবনাও নেই ? কেন ? এত নেই কেন ? এত নেই এর মাঝে মানুষকি বাঁচতে পারে ? পারে না ৷ কিন্তু আমি বাঁচতে চাই ৷ “

অচেতন অবস্থা থেকে চেতনা ফিরে পাবার পরে মানুষ কি করবে ঠিক করে উঠতে পারে না ৷ রিমার কান্না বেশিক্ষন স্থায়ী হল না ৷ কান্না শেষে সক্রিয় হলো অধিকার বোধ ৷ গভীর প্রত্যয়ে বলল, “আমি মা হতে চাই ৷ ফুটফুটে এক শিশু তার ছোট্ট ছোট্ট পায়ে এঘর ওঘর ঘুরবে ৷ দুষ্টুমি করবে , কাগজের দলা পাকিয়ে জানলা দিয়ে ছুড়ে মারবে পথ চলতি মানুষকে ৷ খিল খিলিয়ে হাসবে ৷ এবার পুজোতে না হোক সামনে পুজোর আগেই সে আসবে , বলো আসবে কি না ? আমিতো আমার সবকিছু নিয়ে বসেছিলাম তার অপেক্ষায় , তুমি আমাকে উজাড় করে নিতে পারলে এতদিনে সে নিশ্চিত এসে যেত ৷ ”

বিভাসকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরা দু হাত মুক্ত করে রিমা এক ঝটকায় সরিয়ে ফেললো বুকের আঁচল ৷ কোমরে গুঁজে রাখা শাড়ির গিঁট খুলে মেঝেতে ছড়িয়ে দিতে বৃষ্টি পাগল মাঠের মতো দেখাচ্ছে তাকে ৷ মনে চাষীর তৃষা নিয়ে এমন মাঠেই ঝরে পরতে চেয়েছিলো বিভাস ৷ ফর্সা উন্নত বুক দুটো বহুদিন পিপাসার্ত থাকার পরে জলের সন্ধানে উঁকি মারছে ৷ জীবনের সমস্ত চেষ্টা কোন না কোনদিন ঠিক সফলতা পেয়ে যায় ৷ অন্তত এই মুহুর্তে বিভাসের তেমনই মনে হচ্ছে ৷ তার শত চেষ্টার গুরুত্ব না দিয়ে নিজেকে সরিয়ে রাখা রিমা আজ নিজেই নিজেকে ভিজিয়ে নিতে চাইছে ৷ মাঝে কিছু কুৎসিত সময়ের ব্যবধান ৷ কুৎসিত সময়ের স্মৃতি বানান ভুলের মতো ৷ রাবার দিয়ে ঘষে ফেলতে বিভাস রিমার উন্মুক্ত বুকে মুখ গুঁজল ৷ দুহাতে রিমাকে আষ্টে পৃষ্টে জড়িয়ে ধরে নতুন  রিমাকে আবিষ্কার করল ৷ নতুন রিমা গলা,গাল,কান বিভাসের সর্বত্র ওর ঠোঁটের বীজ বুনে দিতে চাইছে ৷ ওই বীজেই লুকিয়ে আগুনের জন্ম ৷ সেই আগুনে জ্বলতে জ্বলতে বিভাসের মনে হল , সন্ধ্যে হতেই হয়ত বাবা পাখিটি ফিরেছে বাসায় ৷ বাচ্চা দুটোকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে মা পাখিটি ৷ এখন দুজনের খুব খুনশুটি চলছে ৷

Leave a Reply

Your email address will not be published.