“কে বলেছিল তোমাকে আরজি পার্টির ক্যাপ্টেন হতে?” অসীমার গলায় একরাশ বিরক্তি।
সাফাই দেওয়ার মতো করে বীরেশ বলল,”আরে বাবা, কাউকে না কাউকে তো দায়িত্ব নিতেই হত!”
“হুঁ, তুমিই সেই দায়িত্ব নেওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত কিনা! যত্তসব…”
অসীমার রাগ হওয়া স্বাভাবিক। একে তো মাঠের ধারে বাড়ি। আশেপাশে কোনও বাড়ি নেই। সবচেয়ে কাছে বলতে পশ্চিমে প্রায় দু’শো মিটার দূরে মন্ডলদের দোতলা। উত্তর-দক্ষিণ-পূর্বে শুধুই ধুধু মাঠ। এদিকে ঘরেতে বীরেশ ছাড়া বয়স্ক কোনও পুরুষ মানুষ নেই। তা সেই পুরুষও যদি রাতবিরেতে বেরিয়ে যায়, কার ভাল লাগে!
কিন্তু বীরেশকে নিজের গরজেই এই দায়িত্ব নিতে হয়েছে। গ্রামের একপ্রান্তে বাড়ি হওয়ায় নিরাপত্তার স্বার্থে তার মাথাব্যথাই সবচেয়ে বেশি। তার ওপর মাসখানেক আগে হালদারদের বাড়িতে দু’জনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে, যে-ভয়ঙ্কর ডাকাতি হয়ে গেল, তারপর আর কোনও ঝুঁকি নেওয়াই চাই না। এর আগে ছোটখাটো চুরি হয়েছে। রাতে পাহারা দিলে চুরি আটকানো যাবে ভেবে আরজি পার্টি তৈরি করে রাতপাহারা চালু হয়েছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তা কিছুদিন চলেওছে। কিন্তু কনকনে ঠাণ্ডায় বা ঝমঝমে বর্ষায় তা বন্ধও হয়ে গেছে। কিন্তু এবার ডাকাতির ভয়াবহতা সকলের মনে এমন একটা আতঙ্ক তৈরি করেছে যে, মাসখানেক হয়ে গেলেও, মাঘের কনকনে শীত উপেক্ষা করে সকলে পাহারা দেওয়ার জন্য হাজির থাকছে যথারীতি।
দু’-তিনশো মিটার তফাতে পাঁচটা গ্রুপে ভাগ হয়ে তাদের এই পাহারা। প্রত্যেক গ্রুপে তিনজন করে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ মানুষ বাঁশি,পাঁচ ব্যাটারির জোরালো টর্চ আর শক্তপোক্ত বাঁশের লাঠি নিয়ে গাবতলার মানুষের রাতের নিরাপত্তায় মোতায়েন থাকছে। রাত বারোটা থেকে ভোর চারটে পর্যন্ত— চার ঘন্টা তারা টহল দিয়ে বেড়ায় সমস্ত গ্রাম।
আজকে ব্যাপারটা অবশ্য একটু অন্যরকম। বীরেশদের পালপাড়ার রাতপাহারা-দলের দু’জন আজ গরহাজির থাকার খবর সেই সন্ধেতেই ফোন করে তাকে জানিয়েছে। পলাশ শালির বিয়েতে শ্বশুরবাড়ি গেছে আর হিরণকাকু হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাই বুধবার রাতে গার্ড দেওয়া সত্ত্বেও, গ্রুপ-ক্যাপ্টেন হওয়ার দায়ে, আজ রাতে ওদের বদলি হিসাবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে বীরেশকেই।
মন্ডলদের দোতলা বাড়ির সামনে মোড়ের মাথায় তাদের পালপাড়া-গ্রুপের তিনজন জমা হয়। তারপর পাঁচ-ছ’টা ঢালাই রাস্তা ধরে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে সারারাত ধরে ‘হুকুম দো’ দিয়ে বেড়ানো আর কোনও বিপদসংকেত দেখলে বাঁশি বাজিয়ে অন্যান্য গ্রুপকে সতর্ক করা— এই তাদের রাতপাহারা।
বীরেশ বাড়ি থেকে বেরিয়ে মিনিট খানেক এগিয়েছে, ঝুপ করে ইলেকট্রিক চলে গেল। অন্ধকারে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ায় দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হল বীরেশ। সন্ধ্যা থেকে নিম্নচাপের ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় বাধ্য হয়ে জিন্স-সোয়েটার-টুপির ওপর সে রেনকোট পরেছে। রেনকোট পড়তে তার একদম ভাল লাগে না। পকেটে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখার ভারী সমস্যা! আজই যেমন সেই চক্করে মোবাইলটা পর্যন্ত নিয়ে বেরোয়নি। মোবাইলটা থাকলে তবু ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় এগোতে পারত। কী দুর্ভোগ রে বাবা! শীতের বৃষ্টি এমনিতেই বিরক্তিকর। তার ওপর রাতে যদি সেই বৃষ্টির মধ্যে ঘুরে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হয়, কার আর তা ভাল লাগে!
ঘুটঘুটে অন্ধকারে যেন ঢাকা পড়ে গেল বীরেশ। কোথায় একটা রাতচড়া পাখি কর্কশ স্বরে ডেকে উঠল। সামনে একটু দূরে দু’জোড়া চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। সাহসী বলে বীরেশের সুনাম আছে। সাহস না থাকলে কেউ মাঠের ধারে, যে মাঠের ঈশান কোণে শ্মশান, সেখানে নতুন বাড়ি তৈরি করে বসবাস করতে আসে না। ভয় সে পেল না। কিন্তু অন্ধকারে এগোবে কী করে! তখনই তার মনে হল আরে, তার হাতেই তো টর্চ রয়েছে! টর্চের সুইচ টিপে রাস্তা লক্ষ করে আলো ফেলল সে। কিন্তু আলো আর রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছল না। উল্টে টর্চের মিইয়ে পড়া আলোয় অন্ধকার যেন আরও রহস্যঘন হয়ে উঠল! বুধবারেই টর্চের ব্যাটারি ফুরিয়ে এসেছিল। কিন্তু ডিউটি যেহেতু আবার সেই পরের বুধবার, বীরেশ ভেবেছিল রবিবারে টর্চের ব্যাটারি পাল্টাবে। সে আর আগে থাকতে জানবে কী করে— শনিবার, অমাবস্যার অন্ধকার রাতে তাকে বেরোতে হবে! আজ টর্চটা নিয়ে বেরোনোর সময় তার একদম খেয়ালই ছিল না যে টর্চের ব্যাটারি ফুরিয়ে গেছে। ইদানীং রাতে ইলেকট্রিক প্রায় যায় না বললেই চলে। তাই অন্ধকারে হাঁটা-চলা করার কোনও প্রয়োজন হয় না। অন্ধকারে হাঁটার অভ্যাসই চলে গেছে। বড় সমস্যায় পড়ে গেল বীরেশ। কিছুতেই অন্ধকারে চোখ সয়ে নিয়ে এগোতে পারছে না। কিন্তু দেরী করলে তো চলবে না। সবাই বাঁশি বাজিয়ে যে-যার নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে যাওয়ার খবর জানাচ্ছে। তার ওপর অবনীকাকা আজ একা— পলাশ-হিরণকাকু খবরটা তাকে খেয়াল করে দিয়েছে কি না কে জানে! না দিয়ে থাকলে বেচারা মোড়ের মাথায় একা দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করতে করতে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে যাবে।
গা-ঘেঁষে কী যেন একটা চলে গেল। সতর্ক হয় বীরেশ। কিন্তু এই অন্ধকারে কী যে করবে ভেবে পায় না। একবার ভাবে চোখ বুজে সোজা হেঁটে যাবে। কিন্তু সেটা কোনও কাজের কথা নয়। বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ একটু তফাতে রাস্তার দু’পাশে দুটো পুকুর। দুটো পুকুরেরই খাড়াই পাড়। রাতবিরেতে পুকুরে পড়ে কেলেঙ্কারি হোক আর কী! বীরেশ সিদ্ধান্ত নিল ফিরে গিয়ে মোবাইলটা নিয়ে আসবে।
ফিরবে বলে পিছন ফিরতে যাচ্ছে হঠাৎ অনুভব করল সামনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। কার শীতল নিঃশ্বাস যেন তার কপালে লাগল।
“ক-কে?”, নিজের গলার আওয়াজেই ঘাবড়ে গেল বীরেশ। তারপর একটু জোরের সঙ্গে স্পষ্ট উচ্চারণে জানতে চাইল, “কে?”
উল্টো দিক থেকে কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। পরিবর্তে কয়েক সেকেন্ড পরে টর্চের আলো পড়ল সামনে। একটা হাত বীরেশের কাঁধে চাপ দিল। যেন বলতে চাইল আলোটা অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে। বীরেশের আচমকা মনে হল অবনীকাকা নয় তো! কথাটা মাথায় আসতেই তার মনে পড়ে গেল, আরে, তাই তো! অবনীকাকা শনিবারে মৌনব্রত পালন করেন না! হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেই জন্যই উনি কোনও কথা বলছেন না। বীরেশ এবার “চলুন, অবনীকাকা”, বলে নিশ্চিন্ত মনে টর্চের আলো অনুসরণ করল।
কিন্তু এগোনোর জন্য পা বাড়িয়েও সে থমকে দাঁড়াল। টর্চের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেল রাস্তার ওপর খই আর খুচরো পয়সা ছড়িয়ে রয়েছে। সদ্য যেন কোনও শবানুগমনের অনুষঙ্গে ছড়ানো। শ্মশানের রাস্তা তার বাড়ির পাশ দিয়ে গেছে। সন্ধের পর থেকে সে বাড়িতেই আছে। কিন্তু কই, কোনও মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার ‘বলো হরি, হরি বোল’ তো তার কানে ঢোকেনি। অবশ্য জোরে টিভি চললে বাইরের আওয়াজ অনেক সময় কানে আসে না। হঠাৎ তাকে চমকে দিয়ে খইগুলো হু হু করে উড়ে গেল অবনীকাকার দিকে। সে আর কিছু দেখতে পেল না। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়লেও হাওয়া তো দিচ্ছে না! এটা তাহলে কী করে হল? তাকে চমকে দিয়ে ‘খিকখিক’ করে একটা হাসির আওয়াজ ভেসে এল।
“কী অবনীকাকা, আমি দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছি দেখে হাসছেন? চলুন।”
টর্চের আলো নড়ে উঠল। এগোতে লাগল দুজনে। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল বীরেশ। মেঘ চিরে বিদ্যুতের ঝলকানিতে সে সচেতন হল। বিদ্যুৎচমকে দেখল সে একাই হাঁটছে। অবনীকাকা কোথায় গেল! এদিকে টর্চের আলো তো একইভাবে এগিয়ে চলেছে। তাহলে টর্চের আলোটা ফেলছে কে? কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টর্চের আলো নিভে গেল। ঘন অন্ধকারে ঢেকে গেল চরাচর। কাছেই ঠকঠক করে লাঠি ঠোকার স্পষ্ট আওয়াজ কানে এল। এই প্রথম ভিতর থেকে ভয় পেল বীরেশ। কী করবে সে কিছুই ভেবে পেল না। একবার তার মনে হল যে কোনও দিকে দৌড় লাগায়। কিন্তু দৌড়াতে গিয়ে যেন পা আটকে গেল। সেই সময় তাকে চমকে দিয়ে আকাশ থেকে নেমে এল আলোর ঝলকানি। সেই আলোয় বীরেশ দেখল সে শ্মশানের কাছাকাছি এসে পড়েছে। শ্মশানে জনমনিষ্যি নেই। অথচ চিতা জ্বলছে। মড়া পোড়ার তীব্র গন্ধ। কী একটা যেন তাকে ধাক্কা মেরে চলে গেল। সে দেখল একজোড়া জ্বলন্ত চোখ তার দিকে এগিয়ে আসছে। শ্মশানের পাশে তার চোখে পড়ল তিন-চারটে আলোর বিন্দু। হঠাৎ চিতার আগুন দপ করে নিভে গেল। আর তাকে চমকে দিয়ে তার কানের কাছে চার-পাঁচটা কণ্ঠ চিৎকার করে উঠল, “বলো হরি, হরি বোল।”
বীরেশের মনে হল সে এবার জ্ঞান হারাবে। ঠিক সেই সময় শ্মশানের পাশে মন্দিরে জ্বলে উঠল জোরালো আলো। সেই আলোয় বীরেশকে দেখতে পেয়ে শ্মশানযাত্রী সকলে হইহই করে বলে উঠল, “কী ব্যাপার বীরেশ, এত রাতে এই অন্ধকারে তুই এখানে এলি কী করে?… তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন? তোর কী শরীর খারাপ?”
বীরেশ বলল, “সেটাই তো আমিও ভাবছি— এখানে এলাম কী করে! আমি তো গার্ড দেওয়ার জন্য বেরিয়ে পালপাড়ার মোড়ের দিকে যাচ্ছিলাম। সঙ্গে অবনীকাকা ছিল। কিন্তু হঠাৎ খেয়াল করলাম অবনীকাকা হাওয়া, আর এদিকে… আমি এখানে এসে পড়েছি!”
অবনীকাকার পাশের বাড়ির পঞ্চু বলল, “কী বলছিস কী, বীরেশ? অবনীকাকা তো আজ সন্ধ্যায় হঠাৎ স্ট্রোক হয়ে মারা গেছে। তাকে পুড়িয়েই তো আমরা এই শ্মশান থেকে ফিরছি।”
রোমহর্ষক, পড়ে ভালো লাগল