একদিন দু’দিন নয়। হিসেব কষে সাড়ে তিন বছরের সংগ্রাম। প্রথম প্রথম মনের সঙ্গে, তারপর শরীরে। মস্তিষ্কে হিসেবটা কতেই ‘ইচ্ছেশক্তিটা একটু একটু করে বাড়তে থাকে। সুনয়না শােভা আজ বত্রিশে। দীর্ঘ সাড়ে তিন বছর একা সংগ্রাম করে একটা মাথা গোঁজার ঠিকানা পেল। নিজস্ব একান্ত আপন তারই সম্মুখে আজ উচ্চশিরে দাঁড়িয়ে। শােভা দু’চোখ ভরে দেখে বাড়িটি আগরতলার প্রাণকেন্দ্রে বারােশ’ স্কয়ার ফিটের জমিতে গড়া নবজাতক যেন তাকে হাতছানি দেয়। তার কচি হাতের পরশ পেতে মন উড়ু উড় করে। গাড়ি ঢােকার প্রশস্ত তােরণ সহ চারপাশে সাড়ে তিন ফুটের পাচিল ঘেরা বাড়ি। যেন শােভার দেখা সেই স্বপ্নসদৃশ সদন। স্বপ্নোঙ্খিতমন ডানা মেলে দিয়েছে। প্রায় আট ফুটের তােরণের বাইরে দাঁড়ানাে সাড়ে পাঁচ ফুটের শােভা মল্লিক ঘননীল। রংয়ের শাড়িতে যেন গগনসম উচ্চতায়। ফুর ফুরে মন কেবলই নেচে বেড়ায়। চোখ তার বাড়িতে। সুদৃশ্য তার মন তার ভেতরকার সমস্ত তন্ত্রকে নাড়িয়ে দিয়েছে। কিছুদিন ধরেই কোমরের একটা ব্যথা তার নিত্যসঙ্গী। আজ এ লগ্নে সেই ব্যথাও যেন উধাও। শােভা গুণগুণ করে গেয়ে ওঠে গান। এ গান যেন কতদিনের জমা সুর। কথার সঙ্গে মিলেমিশে বেরিয়ে আসছে অন্তর থেকে। গানের মাঝেই প্রতুলকে মনে পড়ে তার। বারবার বলা সত্বেও প্রতুল সঙ্গী হল না। তার সময় নেই। প্রতুলের অফিসই প্রধান। অনুরােধ করতেই প্রতুল বলে উঠল – এটা কোন মিরাক্যাল নয় শােভা। তবে, প্রমাণ করে দিলে, মেয়েরা আজ অনেকটা এগিয়ে। সবেতেই প্রথম । কম কথায় প্রতুল বাক্যগঠন করে ব্যাগ হাতে নেয়। গেট পেরিয়ে সােজা অফিসের পথে। শােভা মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়। স্বামীটা সবকিছুতেই নীরব। ঝড়জলেও নীরব। শুখা মরশুমেও নীরব। আলােতেও নীরব। আঁধারেও নীরব।
স্বপ্নসদৃশ সদনে চোখ শােভার। সামনেটায় কিছু স্পেস রাখা আছে। বাঁ দিকে গ্যারাজ হবে। আর তারপরই এক চিলতে সুশােভিত উদ্যান। স্পেস খুবই কম। ডালিয়া,গাঁদা, গােলাপ তাতেই জেগে উঠবে। মেলে দেবে দল। শরতের সন্ধ্যায় মিষ্টি সুবাস ছড়াতে শিউলি আগে থেকেই প্রস্তুত। একটা পারিজাত পড়বে একদিকে। নার্সারিতে অর্ডার দেওয়া আছে। ওরাই পারিশ্রমিকের বিনিময়ে করে দেবে সব। শােভার চোখে মুখে সুখের ছোঁয়া। কাছেই তাে চাদ, হাত বাড়ালেই তার স্নিগ্ধতার পরশ।।
কলিগদের একতলা দোতলা বাড়িগুলাে দেখে হিংসে হত। কী সুন্দর গােছানাে সবকিছু। প্রতুলকে বলেছে শােভা। ভেতরের গুমরানাে কান্নারা স্বভাষায়ও এসেছে বারবার। কিন্তু প্রতুল প্রতুলেই নেই। একই অংক বার বার। প্রতিবারই, বার বারই নীট রেজাল্ট জিরাে। অবশেষে কেয়াদির হাত ধরা। তাও কি সহজে! একসঙ্গে অটোয় বসে অফিস যেতে আসতে বক-বক,বকবক করে গেছে কেয়াদি। দিনের পর দিন, কেয়াদি শুধু শােভার ভেতরের স্বপ্নটাকে সাজিয়ে তুলেছে। বলেছে। – দ্যাখ, আমার দিকে তাকা। একজন উইডাে। তিন কুলে এক ছেলেটা ছাড়া ছিল কে? দুর্দিনে দেখেছিল কেউ? চোদ্দ বছরের সংসার জীবনের প্রথম সাতেই তাে সব ফাকা। নক্ষত্র পতনের পরপরই শ্বশুর বাড়ি থেকে আউট। বঞ্চিত জীবনে নক্ষত্রের উত্তরাধিকার সূত্রে ডাই-ইন-হারনেসে এই অধমার অধস্তনের এই কেদারাটা। যার হাতল দুটোয় ভর করে ক্রমশঃ এগিয়ে যাওয়া। এক পা দু পা করে সঠিক পথটুকু খুঁজে নিয়ে দাঁড়ানাে। আর তারপরই তাে বাঁশি বেজে উঠল। শরীরে মনে সংগ্রাম হল শুরু। আর তার ফল আজ এই গােটা বাড়ি। মাথায় হাত। আমার নক্ষত্রের পরিজনদের পড়ল দৃষ্টি। চোখে বিষ, মুখে বিষ। সবারই। আমার –! দুর, অত ভাববে কে । সময় কোথায়। আমার ছেলে এখন এক বেলা এসি না চললে ঘুমােবেই না। কেয়াদি দামি ফ্রেমের চশমাটা খুলে দামি পানের পিকটা ফুৎ করে ফেলে দেয় স্বচ্ছভূমিতে। মুখে তার মহামূল্যের জর্দার মিষ্টি সুবাস। কেয়াদির কল্যানেই শােভা আজ এত দূর। কেয়াদি দেখতেও বেশ। প্রকৃতি তার প্রাকৃতিক ভেষজে ঘিরে রেখেছে কেয়াদিকে। ছত্রিশেও কেয়াদি তাই ঠাসা । মেয়েবেলার পােশাকে পথে নামলে যে কেউ তাকাবেই। মনে মনে বলে শােভা, হা এমনই হওয়া উচিৎ। ছন্দ পতন হবে কেন। আজকাল কেয়াদির মতই পান চিবােতেও শিখেছে শােভা। মাসের নানান প্রয়ােজনীয় জিনিসগুলাের সঙ্গে জর্দাও ঢুকে পড়েছে। জর্দার সঙ্গে বৃহৎ সেই তালিকায় পান মশলাও। প্রতুল ওসবে নেই। দেখেও দেখে না প্রতুল। তার এ সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাস্যও নেই। ইদানিং প্রমােশন নিয়ে আরেকটু উপরে গেল। উপরে গেল মানে কাজের বহরে সময়ে গেল। অফিসটা সম্পূর্ণ মুখ্য। বাড়িটা হয়ে গেল গৌণ। প্রতুল এখনও শােভার শােভা দেখেইনি। শােভার ঠোটের কোনে ঝিলিক মেরে ওঠে এক চিলতে হাসি। কেয়াদির সাজেশনে শােভার শােভা আজ ছড়িয়ে পড়েছে।
অর্গল সরতেই সাত তারের সুর যেন এক সঙ্গে বেজে ওঠে।সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথও যেন। এগিয়ে এলেন। এসাে এসাে , আমার ঘরে এসাে, আমার ঘরে। শােভা পায়ে পায়ে মূল ফটকে। আরেকবার আরেকটা অর্গল। গ্রিলের দরজা। তারপর বারান্দা। তারপর দামি গ্লাসের দরজা। তর তর করে সব ছেড়ে দিল বন্ধন। এবার ভেতর মহল। ঢুকতেই ড্রয়িং। সাবেকি আর আধুনিকের মেল বন্ধনে সব ফার্নিচার। অপেক্ষায় সব। ঠিক পেছনেই আহার মহল। তারপর কিচেন। ডান দিকে পরপর দু’টো শয়ন কক্ষ। তার ঠিক পেছনেই বুবুনের অধ্যয়ন কক্ষ। বাড়ির নর্থওয়েস্ট সাইড জুড়ে টয়লেট। দু‘ভাগে দুটো। একটায় ইন্ডিয়ান। একটায় কোমট। যার যেমন প্রয়ােজন। পাশেই আলাদাএকটা চান ঘর। একটা বাথটব লাগানাের ইচ্ছে আছে চান ঘরে। গিজারও রাখতে হবে। প্রতুল শীত এলেই গরম জল চায়। অলস প্রাণীটিকে বার বার গরম কল করে দেওয়ার লােক নেই। কাজের মাসি প্রায়ই বিরক্ত হয়। এই হ্যাপা আর নয়। নব ঘুরবে , ঠান্ডা জল। নব ঘুরবে, গরম জল। চার দিকে তাকায় শােভা।সবুজ মন চার দেওয়ালে সবুজ হয়ে আজ স্পষ্ট। শােভা এবার বারান্দায়। একপাশে ঠাকুর ঘর। শ্বেত পাথরে সাজানাে সব। একটা গাড়ির যেমন তার অপেক্ষার তালিকায়,শখের এসিটাও পাশেই।
প্রভিশন রাখা আছে। সব কিছু গুটিয়ে গুটিয়ে দেখে শোভা। এ না করে ফেল। কিছু পাশের নেশা, কিছু চাপায় মেশা। তাই নিয়ে মনে মনে…। গান থেমে যায় মাঝ পথে। একটা বড়সড় গরম বাতাস নাক দিয়ে বেরিয়ে আসে। কত কী হয়ে গেল এই বাড়ির স্বপ্নে। বাস্তবের ভিতে বাস্তব হয়ে উঠতে গিয়ে কত কিছু হয়ে গেল। প্রতুলকে কত বোকা। নির্বোধ প্রতুল হয়তাে বাড়ি প্রবেশ করেই বলবে। সব ঠিক হ্যায়। এভরিথিং ইজ ওকে। বা হাউ ফাইন। হয়তাে গেয়েই উঠল, আহা – কী দারুন দেখতে। অথচ জানলােই না বা জানার প্রয়ােজনটুকুও বােধ করেনি প্রতুল, কি করে কী হল। প্রভিডেন্ট ফান্ড তার ফাঁকা । সাড়ে পাঁচ লাখ তুলে সরাসরি শােভার হাতে দিয়েই খালাস। তারপর । শােভার পিত্রালয়ের জমির এক খন্ড, তার জন্যে নির্দিষ্ট অংশটা বিক্রি হল। তার নিজস্ব ফান্ডের অংশ। সব শেষ। তারপরও বাকি বিশাল অংক। বর্তমান আগরতলার শ্বাসনালীর যৎসামান্য জমিতে এ বিশাল। যজ্ঞের সিংহাংশটা কী করে এল, একবার ভাবলও না প্রতুল। কোন কষ্টি পাথরে যে প্রতুলকে গড়েছেন। ভগবান, তা তিনিই জানেন।
কাল অক্ষয় তৃতীয়া। পন্ডিতদের মতে সকাল আটটা থেকে ন‘টার মধ্যেই শুভক্ষণ। এ লগ্নেই প্রবেশ প্রশস্ত। তারপরই বারবেলার শুরু। একটা নিঃশ্বাস নেয় শােভা। মনে পড়ে তার আর প্রতুলের এ সম্পর্কিত কিছু খন্ড যুদ্ধের কথা। এ যেন এক ইতিহাস। পাতাটা তার বদলে নতুন করে খুলে গেল আজ আরেকটি পাতা। বেশ মনে পড়ে আজও। স্পষ্ট কথায়, স্পষ্ট ভাষায় প্রতুল বলেছিল এসব। আগরতলা আর আগরতলায় নেই। গত দেড় দশকে খােল নলচে বদলে গেছে। সেদিনের সেই ছােট্ট খােকাটি আর নেই। সেই কংক্রিটের সরু অলি গলি মত পথ আজ পিচ ঢালা বেশ প্রশস্ত। একসঙ্গে দু’খানা তাে বটেই, কোথাও কোথাও চার ইঞ্জিন ছুটছে সমানে। রাতগুলাে যেন আলাে ঝলমল দিন। চারদিকে চোখ ধাঁধানাে প্রাসাদোপম সব বাড়ি । হােটেল, রেস্তোরাঁ, মল। সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে তৈরী প্রকান্ড সব আবাসন। আরও কত কী যে হল। রাজ্যটা এগােতে এগােতে অনেক দূর চলে এল। সাধারণদের যানবাহনের হ্যাপা সামলে ছুটতে হয় না এদিক ওদিক । হাত বাড়ালেই সব হাজির। আসছে বিদেশী সওদাগরগণ। শিল্প কারখানা গড়ার প্ল্যান হাতে হাতে। উদ্যোগী সীমানা ছাড়িয়ে ত্রিপুরার ভূখন্ডে। ত্রিপুরা শিখরে পৌছতে মরিয়া। কিছু কল কারখানা। ইতিমধ্যেই তৈরী। কাজ চলছে কোথাও। কোথাও শিলান্যাস। এখানে এখন টাকা হাতে মানে বাঘের দুধও কাছেই। বিপ্লবী মন বিবর্ণকে পেছনে ঠেলে নিজেকে বিকশিত করেছে যেমন, ফলাফলও। তেমনি। উন্নয়নের কল্যাণে জমির মূল্য লাফিয়ে মগডালে। হাজার বা লাখ। আঙ্কিক এই শব্দরা অভিধান থেকে উধাও। কোটি কদম কদম এগিয়ে ঠিকানা করে নিয়েছে এই শহরে। বাস্তবে বাস্তুর স্বপ্ন মানে মধ্যবিত্তের বিনিদ্র রজনী। তার চেয়ে ভরা বাড়িতে নিশ্চিন্তে নিদ্রা যেতে নিশ্চিন্তি। ব্যাস। এইটুকুন অব্দিই। প্রতুল এরপরই সম্পূর্ণ নীরব। প্রতুল কি জানে , উন্নয়নের ছাপ্পা পড়তেই কিছু বিষও কোন ফাঁকে ঢুকে পড়েছে, ছােট্ট এই শহরে। পুর্নিমার থালামত চাঁদ খােলা জানালার গ্রিলের ফাঁক গলে ভাড়ার বাস্তু স্পর্শ করলেও ঘরে লােডশেডিংয়ের কালাে ছায়া। বাক্য গঠনে নির্ভুল শােভা।
চেঁচাচ্ছে একই স্বরে। বিয়ের সেই শুরু থেকে টানা বারাে বছর। চলছে একই সংলাপ। আমি না হয় নতুন। সবে রেগুলার। জাস্ট টু ইয়ার্স গন। তােমার তাে উনিশ গেল। কুড়ি বছর সার্ভিস লাইফ রানিং। কী করলে। টকঝক চলছে সমানে। কিন্তু সমস্যা সেই তিমিরে। প্রতুল নীরব। এবারও চুপচাপ নিজেকে শক্ত করে শােভা। নিজের হাঁটুর শক্তি নিজেকেই বাড়াতে হবে। শক্ত পণ করে বসে শােভা মল্লিক। প্রতুলকে ওভারটেক করেই পায়ে পায়ে এগুতে হবে। নিজেরই ঘাড়ে তুলে নিতে হবে নিজেকে। পথ খুঁজে নিয়ে তাই এগিয়ে যায় । সফল হয় শােভা। সেই সােনালী ফসল তার কাছেই দাঁড়িয়ে।
আজ শােভার বড়ই সুখের দিন। নিশ্চিন্তের রাত। বুবুনটা ঘরে ঢুকেই হৈ হৈ শুরু করে দিল। ওর জন্যে স্পেশাল গিফট, অ্যা লিটিল রিডিং রুম। ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে সবে সপ্তম শ্রেণিতে বসছে বুবুন। এখনই সেপারেশনে এত আগ্রহ। আজকাল বাচ্চারা ছােটতেই বড় হয়ে যায়। শােভা মাঝে মাঝেই ভাবে, কী সময় এল দেখ। বুবুনের দিকে তাকিয়ে শােভা মুচকি হাসে। কিন্তু প্রতুলের তাে দেখা নেই এখনও। প্রতুলটা যে কী!
সন্ধ্যেও তাই। বাড়িতেও অফিসের ফাইল আর ফাইল। কী সব লিখে চলেছে। দেখছে ,পড়ছে । নােট দিচ্ছে। রাতে এক সঙ্গে খাবার টেবিলে বসছে। আড্ডা মারছে, খাচ্ছে। আবার সময় হলেই বিছানায় চলে যাচ্ছে। পড়েই ঘুম। কথায় কথায় বলছে, দারুণ কাজ করেছে। বা তােমার তুলনা নেই ! ব্যাস। সােজা শােভা রচিত সুশয্যায়। টান টান করে শরীর এলিয়ে দেয় প্রতুল। পড়তেই যেন কত কালের না হওয়া ঘুম , এগিয়ে এল দু’চোখে। দৃশ্যটা শােভার দু চোখকেও দেয় সস্তি। এক চিলতে হাসি তার ঠোটের কোনে। মৃদু হেসে বেরিয়ে যায় শােভা। দিনের কাগজটা নিয়ে এগিয়ে যায় দক্ষিনের ঝুল বারান্দায়। আলােটা জ্বেলে আরাম দোলনায় বসে দুলতে দুলতে সংবাদ সাহিত্যের পাতাটায় চোখ রাখে। কতদিন দেখা হয় না এসব। নির্দিষ্ট কিছু খবর ব্যতিরেকে আর সবে চোখ রাখবে, সময় কোথায়। অনেক দিন বাদে ফের পাতাটা ভেসে ওঠে দু চোখের সামনে। পায়ের উপর পা তুলে চোখ রাখতেই ভক করা একটা গন্ধ। বেশ কদিন নাকে লাগছে।বাইরে কিছু ফেলেছে কি কেউ! শােভা কাপড়ের আঁচল নাকে চেপে ফিরে আসে ঘরে। টেবিলে বসে ফের পাতাটা মেলে ধরে। গল্প , কবিতার পাতাটায় চোখ রাখে।এটা ওটার পর চোখ যায় মাঝখানে ছাপা কবিতাটিতে। বার কয়েক পড়ে কবিতাটি। পড়তে পড়তেই কেমন যেন হয়ে যায় শােভা। কবি শুভেশ চৌধুরী বেশ লেখে। আরও পড়েছে তার কবিতা। কিন্তু আজকেরটা যেন কী রকম ঠেকল।সব ক’ টার অর্থ ঠাহর করে উঠতে পারে না শােভা। পায়ে পায়ে বেড রুমে ঢুকে শােভা। বিছানায় প্রতুল নাক ডাকাচ্ছে। মাঝখানে বুবুন। দিব্যি বাপ ব্যাটায় নিশ্চিন্তের নিদ্রায়। প্রতুলের সারল্য ভরা মুখটায় কিছু কি ভাসছে! না, অলস শরীরটা নতুন ঘরে পুরনাে ঢঙেই শায়িত। আয়েশি বিছানায় এলিয়ে শরীর এখন ঘুমন্ত। ধীর পায়ে তার কাছ ঘেঁসে শুতে যায় শােভা। কিন্তু না, কী একটা যেন আটকে দেয়। বিছানায় বালি বালি ঠেকে। মনে মনে ভাবে, প্রতুলটা বড় বেশী অলস। দ্যাখ , বালি ঢালা বিছানাতে ই কেমন নাক ডাকছে।
শােভা আলো জ্বেলে ধূলো বেড়ে শুতে যায়। ফের । কিন্তু না, শুতে গেলেই লালিরা যেন খোঁচা দেয় । চাদরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেন্ট্রির মত যেন ঢুকে আছে বালি। মনে মনে ভাবে, সারা বিকেল বুবুট। এই বিছানাতেই খেলবে। কত দিন বারণ করেছে। কার কথা কে শোনে। প্রতুলও, বড় মোছার প্রয়োজনই নেই। পড়াে আর নাক ডাকাও এই তার রুটিন যেমন বাপ , তেমনি তার ছেলে। বিরক্ত শোভা আলাে নিভিয়ে শাড়ির আঁচল পেতেই শুয়ে পড়ে।
মাঝ রাতে দু’চোখ আচমকাই খুলে যায়। ফের সেই গন্ধ। গত দু‘টো তার এক হবেই না। বেশ ক’ দিন । কেমন একটা গন্ধ যেন বার বার নাকে লাগছে। প্রতুল বলছে, রং। ওটা রংয়ের কাঁচা গন্ধ হতে পারে। নতুন। সবে লেগেছে বাড়িতে। দু’দিন যাক, সব ঠিক হয়ে যাবে। বুবুটের তো সে খেয়ালই নেই। সকালে কাজের মাসি এল। কথাটা পড়তেই তেতে ওঠে। দেখো, দাদাবাবু মাছ আনলেই ধুইয়া মুইচ্ছা সব পরিস্কার। এমন পরিস্কার কাজ আমি করিনা। কিন্তু শোভার নাক থেকে গন্ধটা যে সরছেই না। দু’বেলা নিয়ম করে রুম ফ্রেশনার স্প্রে হচ্ছে সারা ঘরে। জানালা, দরজার পর্দা থেকে প্রায় রান্নাঘর। কিন্তু গন্ধ তার স্থান পরিবর্তন করে না। নাকে ভক করে লাগছে। ইটের প্রতিটি পাজরে যেন আটকে আছে এই বিষয়। আবদ্ধ ঘরে সুযােগ বুঝে ফের হানা দিয়েছে। শোভা চঞ্চল হয়ে ওঠে। একটা যন্ত্রণা এগিয়ে আসে বার বার। নীরবে বসে থাকে শোভা। মাঝ রাতে এক ঘর আলোয় ঘুম ভেঙে যায় প্রতুলের। চোখে পড়তেই প্রতুল এগিয়ে যায়। প্রতুলের স্পর্শে চমকে ওঠে শােভা। প্রতুল কি সান্তনা বাক্য গঠন করছে ! কানের কাছে দাঁড়িয়ে প্রতুল বলল – লােনের ব্যাপার তাে , ভেবােনা। আমিও তাে আছি। অত ভাববার কী আছে শুনি। কথা ক’টি বলেই প্রতুল আলােটা নিভিয়ে দেয়। শােভা নীরব। রক্ত মাংসের ভেতরে যেন কী একটা খোঁচাচ্ছে অবিরাম।কেবলই একটাই কথা – প্রতুলের অজান্তে সব হল। অমন কিছু করা কি ঠিক। ভালাে কজের জন্যে আত্মত্যাগ চলে। কিন্তু একে কোন ত্যাগ বলা যাবে। পার্সে লুকনাে পাস বুকটা নেয় শােভা। সেভিংসে অন্যান্য ডিপােজিটগুলাে ঠিকই আছে। কিন্তু বেশ কিছু ডিপােজিট যেন তার নিজস্ব কাম ছাড়িয়ে গেছে। ভিন্ন লাইনে সার সার তারা দাঁড়িয়ে পড়েছে। প্রতুলের হাত পড়বে না তাে, এতে। না , প্রতুল অন্যের জিনিসে হাত দেবে না। ওটা তার স্বভাব বিরুদ্ধ। কিন্তু যদি কোন ভাবে পড়ে হাতের কাছে। বা মাটিতে। একদম খুলে টুলে। আমি হয় তাে কাছেই নেই। প্রতুল দেখছে, কী একটা মেঝেতে লুটিয়ে । এগিয়ে গেল সে। হাতে তুলে নিল। খােলা পাস বুক প্রতুলের হাতে। প্রতিদিনই তাে পারপেডিকিউল্যার ট্র্যাঞ্জেকশান। প্রায়ই। দুই, তিন। কখনাে আড়াই। সাড়ে তিন কখনাে সখনাে। সেভিংস লাইনে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে প্রিন্টেড কারেন্সিরা। কখনাে ক্যাশ। কখনাে চেক তার নম্বর সহ বসে আছে। তাদের উৎস ?
ঘেমে নেয়ে একসা শােভা। শ্বাস ঘন ঘন ওঠা নামা করে। ক্লান্তি আর অবসাদ ঘিরে ধরে তাকে। আঁচলে মুখ মুছে বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়ায়। বুকের লাবডুপটা ছাড়িয়ে যাচ্ছে স্বাভাবিক গতিকে । হারিয়ে ফেলছে নিজেকে। খুঁজে নিচ্ছে হারানােতেই। একটা অসীমান্তিক জড়তা যেন জড়িয়ে ধরছে শােভাকে। শিউড়ে ওঠে শােভা মল্লিক। চোখের কোন দু’টো চিক চিক করে ওঠে তার। মাঠের সােনালি ধান গােলায়। নবান্ন হবে তাে ঘরে ।