সেদিনও বৃষ্টি হয়েছিল। দুপুর থেকেই টিপটিপ বৃষ্টি। বৃষ্টি হলেই কেয়ার মনখারাপ হয়। কেন হয় এই সাতাশ বছরে আজও ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি কেয়া। বুকের ভিতর এক অদৃশ্য দরজা খুলে যায়। খুব ইচ্ছে করে এক ছুটে তার কাছে পৌঁছে যেতে। তারপর খুব করে জল মাখতে দু-জনে। বৃষ্টি পড়লেই মনের আলোগুলো নিভে যায়। খুব একলা লাগে তখন। একটু আগেই কলেজ থেকে ফিরেছে, শহরেই একটা কলেজে পার্টটাইম লেকচারার কেয়া। অবিরের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়েছে তিন বছর হল। গতকাল রাতে তিস্তা ফোন করেছিল। তিস্তা ওর কলেজ জীবনের রুমমেট। এখনও সেই মাখামাখা বন্ধুত্বটা রয়ে গেছে ওদের। হয়তো কিছু বন্ধুত্ব সব ঝড় ঝঞ্ঝা কাটিয়ে এভাবেই সারাজীবনের জন্য থেকে যায়। যদিও কেয়া বিশ্বাস করে পৃথিবীতে সব সম্পর্কেরই একটা ভ্যালিডিটি আছে। কিন্তু তিস্তার ক্ষেত্রে এ সূত্রটা একটু ব্যতিক্রম। তিস্তা বলছিল ওদের বিয়ের কথা। বিয়ের তিন বছর পর সব স্বামী-স্ত্রী ভাইবোন হয়ে যায়। তার মানে এই নয় যে সম্পর্কের গভীরতা কমে। হয়তো একটা অভ্যেস তৈরি হয়, একটা অলিখিত দায়িত্ববোধ জন্ম নেয়, পারস্পরিক তৈরি হওয়া একটা বোঝাপড়ার সুতো বেঁধে রাখে দুটো মানুষকে। এই সবকিছুই ঠিক। কিন্তু তাও কোথাও গিয়ে বিয়ের আগের সেই মুগ্ধতাটা কেটে যায়। সেই ক্রেজি ব্যাপারটা মরে যায়। অনেকটা স্থির জলের মতো। যেখানে ঘন্টার পর ঘন্টা পা ডুবিয়ে চুপ করে বসে থাকা যায় কিন্তু হঠাৎ করে দু-হাতে জল মেখে ভেসে যাবার ইচ্ছেটা থাকে না। তিস্তা ফোন রাখার পর সে রাতে ঘুম হয়নি কেয়ার। বিছানায় ঘুমন্ত আবিরের পাশে শুয়ে মনে মনে একটা নতুন আকাশ দেখেছে কেয়া। যে আকাশে ওড়ার জন্য কোনও ভিসা লাগে না। মুক্ত বিহঙ্গের মতো ডানা ঝাপটাতে ইচ্ছে করে।
তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা, ফোন থেকে একটা উবের বুক করে কেয়া। ডেস্টিনেশন বিক্রমগর বাজার। ওখানেই সংকেতের বাড়ি। গত পরশু ইউএসএ থেকে ফিরেছে সংকেত। নাসায় স্পেস রিসার্চের কাজ করে, বয়স আটচল্লিশ, ঝকঝকে সুদর্শন খুব হাম্বল ব্যবহার। এক কথায় ব্যক্তিত্বপূর্ণ সাকসেসফুল পুরুষ। তিস্তা নিয়মিতভাবে সংকেতের ব্লগ ফলো করতো। চমৎকার লেখার হাত মানুষটার। সহজভাবে মানুষের মন নিয়ে কি অদ্ভুত সব বিশ্লেষণ। যত জেনেছে মানুষটাকে মুগ্ধ হয়েছে কেয়া। হয়তো একটা অদৃশ্য আকর্ষণও তৈরি হয়েছে সংকেতের প্রতি। অনেক খুঁজে ফেসবুকে নিজেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল কেয়া। সেও বছর খানেক আগের কথা। তারপর ইনবক্সে কথা, সেখান থেকে ভিডিও কল। মাস ছয়েক আগে যাদবপুর ইউনিভার্সিটির একটা সেমিনার অ্যাটেন্ড করতে কলকাতা আসে সংকেত। সেই প্রথম সামনা সামনি দেখা। অডিটোরিয়ামে বসে সংকেতের লেকচার শুনে এক কথায় মুগ্ধ হয়েছিল কেয়া। চুম্বক যেভাবে লোহাকে টানে সংকেতের উজ্জ্বল চোখদুটো পাগলের মতো টানছিল কেয়াকে। লেকচার শেষ হতেই স্টেজ থেকে নেমে নিজেই এগিয়ে এসে হালকা স্মাইল দিয়ে হাতটা বাড়িয়ে দেয় সংকেত। বেশ মনে আছে তারপর পাশেই একটা কফিশপে ঘন্টা দুয়েক কেটেছিল ওদের। কেয়ার মনে হয়েছিল সংকেতের কথার মধ্যে অদ্ভুত একটা বৃষ্টির ঘোর আছে। তবে সে ঘোর মনখারাপ নয় অন্ধকারে জোনাকির মতো আলো হয়ে ওঠে। এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই উবেরের জানলা দিয়ে বাইরে তাকায় কেয়া। তখনও বাইরে হালকা বৃষ্টি। বিকেলের চোখে যেন সন্ধে মিশে যাচ্ছে। কেয়ার মনে হয় হুইস্কির গ্লাসে যেভাবে গলে যায় একাকি আইস কিউব, ঠিক যেন ভিড়ের মধ্যে একা একটা শহর গলে যাচ্ছে। যার চোখ থেকে টুপটুপ করে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে জল। আনমনে মোবাইলটা হাতে নেয় কেয়া। না সংকেতকে এখন ফোন করবে না। এটা ওর জন্য সারপ্রাইজই থাক। সকালে কেয়াকে ফোন করেছিল সংকেত। একটা আর্জেন্ট মিটিংয়ের জন্য কালই কলকাতায় এসেছে। আজ বিকেলে ক্যালকাটা ক্লাবে দেখাও করতে চেয়েছিল ও। কিন্তু ওই কেয়ার অভিমান, কেন ওকে আগে আসার কথা জানায়নি সংকেত। সংকেত অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কেয়াও নাছোড় ও দেখা করবে না। দুপুরে আবার এই নিয়েই একচোট ঝগড়া হয়ে যায় ফোনে। কেন যে ছেলেরা বোঝে না। হয়তো এই একটা জায়গায় গিয়ে সব পুরুষই এক। হ্যাঁ আর না এর মধ্যে অদৃশ্য ব্রিজটা কোনদিনই ওরা দেখতে পায় না। হয়তো চেষ্টাই করে না। নিজের মনেই হেসে ওঠে কেয়া। আর মিনিট পনেরো তারপর দেখা যাবে আসল সারপ্রাইজটা কে কাকে দেয়।
পার্স বের করে টাকাটা মিটিয়ে গাড়ি থেকে নামে কেয়া। খুব হালকা লাগে নিজেকে। প্রতিবার বৃষ্টি থেমে গেলে এরকমই হয়। কিন্তু আজ এখনও কিছুটা মেঘ থেকে গেছে আকাশে। চারিদিকে এত আলো তাও যেন মনে হচ্ছে কিছুটা অন্ধকার এখনও লেগে আছে চোখে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বুক ভরে নিশ্বাস নেয় কেয়া। সংকেতদের বাড়িটা বেশ পুরোনো। দোতলা বিশাল বাড়ি। পুরোটা জুড়েই আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। থাকার মধ্যে বয়স্ক মা আর দু-জন অ্যাটেনডেন্ট। শুনেছে ওর মা-বাবা দুজনেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন। বাবা বছর পাঁচেক আগে মারা যান। আর সংকেত বছরে এক দু-বার কলকাতায় এলে তখন মার কাছে থাকে আর কি। আজ হলুদ পরে এসেছে কেয়া। হলুদ সংকেতের প্রিয় রং। মোবাইলে নিজেকে দেখে মুচকি হাসে কেয়া, তারপর দরজায় কলিংবেল দেয়। এক মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোক দরজা খুলে দেন।
-হ্যাঁ ম্যাডাম বলুন
-স্যার বাড়িতে আছেন তো?
-হ্যাঁ, এই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে চলে যান। ডানদিকে।
কেয়া সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে একটু থমকে দাঁড়ায়। বিরাট বারান্দায় পেইনন্টিংগুলো দেখে আগেরবারও মুগ্ধ হয়েছিল কেয়া। ওর মুখেই শুনেছে এগুলো সংকেতের কলেজবেলার কাজ। মানুষটার মধ্যে কতো ট্যালেন্ট। সত্যিই তো এই ট্যালেন্টের জন্যই সংকেতের প্রতি একটা আলাদা শ্রদ্ধা তৈরি হয়েছে। হয়তো আকর্ষণটাও বেড়েছে দিনদিন। নাহলে কি কেয়ার মতো মেয়ে ছুটে আসে। ও তো চিরকাল মেধার মধ্যেই পূর্ণতা খুঁজেছে। হয়তো ভালোবাসাও। বারান্দা দিয়ে ডানদিকে এগিয়ে যায় কেয়া, এটাই সংকেতের ঘর। মনে মনে ভাবে কেয়াকে দেখার পর সংকেতের এক্সপ্রেশনটা ঠিক কেমন হবে… ও কি শান্ত ভাবে জড়িয়ে ধরবে কেয়াকে! আবার কি ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে শহর জুড়ে। তখনও কেয়া জানে না দরজার ওপারে ওর জন্য আসল সারপ্রাইজটা অপেক্ষা করছে। উত্তেজনায় দরজা নক করে না কেয়া, ঝড়ের মতো ঢুকে পরে ঘরে। আর তারপর মুহূর্তে সবকিছু ঝাপসা হয়ে যায়। আচমকা খুব জোর শক খেলে যেমনটা হয়। কানে তালা লেগে যায়, চোখের সামনে ব্ল্যাঙ্ক হয়ে যায় দুনিয়াটা। কেয়ার মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোয় না। প্রচণ্ড অন্তরঙ্গ মুহূর্তে ছিটকে ওঠে সংকেত। মেয়েটি চাদর টেনে যথাসম্ভব ঢেকে নেয় নিজেকে। সংকেত এক নাগাড়ে কিছু বলতে থাকে, ওর কোনও কথাই মাথায় ঢোকে না কেয়ার। এক ঝটকায় সংকেতের হাত ছাড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসে কেয়া। ওর দু-চোখে তুমুল বৃষ্টি। সারা শরীরে জল ভাঙছে। পা দুটো কিছুতেই মাটিতে থাকতে চাইছে না আর। জীবন সত্যিই প্রতিটা মুহূর্তে কতো কিছু চোখে আঙুল দিয়ে শিখিয়ে দিয়ে যায় আমাদের। এভাবে একটা মানুষ কীকরে পারে, মুহূর্তের জন্য সাবস্টিটিউট খুঁজে নিতে। আকাশে কালো মেঘ। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। খুব ভিজতে ইচ্ছে করে কেয়ার। এই মুহূর্তটাকে ধুয়ে মুছে ফেলতে ইচ্ছে করে। আবিরকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে। আবিরের বুকের মধ্যেও কি মেঘ ডাকছে। কি করছে আবির! ঘড়িতে পৌনে সাতটা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কেয়াকে নিজের কাছে ফিরতে হবে। আবির হয়তো ওর জন্য চা নিয়ে অপেক্ষা করছে…