২০২১ সালের পনেরোই জানুয়ারি। নরওয়ের অসলো বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারদের একেবারে হিমসিম খাওয়ার অবস্থা। একের পর এক নামছে নানা দেশ থেকে আসা ফ্লাইটগুলো। বাছা বাছা পৃথিবীবিখ্যাত সব মানুষদের সর্বসম্মতিক্রমে ডেকে আনা হয়েছে সেখানে। গোটা পৃথিবীতে, মহামারি ভাইরাসের চারটে মাত্র ভ্যাকসিনই এখনও পর্যন্ত তিনটি ট্রায়ালে উত্তীর্ণ হতে পেরেছে। এবার তাদের চূড়ান্ত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালটিই হবে এই পনেরো দিন ধরে। এর ঠিক পরেই ঘোষণা করা হবে সফলতম ভ্যাকসিনটির নাম এবং তার পরেই বাণিজ্যিকভাবে তা তৈরি ও বিক্রিও শুরু হয়ে যাবে পৃথিবীময়। তাই সারা পৃথিবীর নজর এখন অসলোর দিকে।
আসার সঙ্গে সঙ্গে, স্টাডি গ্রুপ অনুযায়ী এসকর্ট করে মানুষগুলোকে নিয়ে গিয়ে, বিমানবন্দরের লাউঞ্জেই তৈরি একটা অস্থায়ী ক্লিনিকে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। সেখানে তাদের ভালভাবে স্যানিটাইজ করে, প্রয়োজনীয় টেস্ট করে, তারপর ভ্যাকসিনেশন পর্বও সারা হয়ে গেল। তারপর দ্রুত তাদের ঢুকিয়ে দেওয়া হল লাউঞ্জেরই আলাদা আলাদা চারটে বিশাল এয়ার কন্ডিশনড ঘরে। প্রতি ঘরে দশ জন করে। আলাদা ঘর, আলাদা ভ্যাকসিন। বিলাসবহুল সেইসব ঘর থেকে তাদের কাউকে বের হতে দেওয়া হবে না আগামী পনেরো দিন। প্রতি ঘরে লুকোনো রয়েছে ক্যামেরা এবং মাইক্রোফোন। প্রতি মুহূর্তে নজর রাখা হবে তাদের শারীরিক অবস্থা, কথাবার্তা, চালচলন সবকিছুর উপর। আলাদা একটা কন্ট্রোল রুমও লুকোনো রয়েছে ওই লাউঞ্জের ভেতরেই, যেখানে অপারেটররা সর্বক্ষণ তাদের ভিডিও এবং অডিও রেকর্ডিং করে চলবে।
প্রথম ঘরে রয়েছেন পৃথিবী বিখ্যাত সব বিজ্ঞানীরা, নানা দেশের, নানা বয়সের, নারী-পুরুষ মিলিয়ে। দ্বিতীয় ঘরটাতে রয়েছেন দুনিয়ার প্রথম শ্রেণীর সমস্ত পর্নস্টারেরা। তৃতীয় ঘরটাতে পৃথিবী-বিখ্যাত সব কবিরা আর চতুর্থ ঘরটাতে সেরকম নামকরা কেউ নেই, শুধু বেশ কিছু পাঁড় মাতালদের এনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেইসব মাতাল আর নেশাড়ুদেরও অবশ্য ধরে আনা হয়েছে পৃথিবী বিখ্যাত সব শুঁড়িখানার লিস্ট ধরে ধরে। সবার জন্যই থাকছে এলাহি খাওয়া-দাওয়া আর সমস্ত আধুনিক সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা। শুধু শর্ত একটাই, ঘর ছেড়ে বেরোনো যাবে না এই ক’দিন। ঐ ঘরের মধ্যেই থাকা-খাওয়া-ঘুম। আর দুটো ব্যাপার, তাদের যে গোপনে ছবি তোলা হচ্ছে আর কথা রেকর্ড করা হচ্ছে, সেটা তারা জানবে না; আর তাদের কাছে কোন মোবাইল ফোনও থাকবে না। ফলে ঘরের বাইরের জগতের সঙ্গে তারা কোনভাবেই কোনো যোগাযোগ করতে পারবে না। অবশ্য টিভি বা রেডিও সবই আছে ঘরগুলোতে, কিন্তু বাইরের কোনো লোকের সংস্পর্শে তারা এই ক’দিনে আসতে পারবে না। খাবার, জল, ওষুধপত্র, নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তাদের প্রয়োজনমতো স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে জোগান দেওয়া হবে। এমনকি সময় সময় স্বাস্থ্য পরীক্ষাও করা হবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে।
অপারেশন আপসাইলন শুরু হয়ে গেল। প্রথম ঘরটাতে যেসব বিজ্ঞানীরা রয়েছেন, ভ্যাকসিনের ডোজ পেয়ে যাওয়ায় তারা বেশ ফুর্তিতে ছিলেন।
‘কী রে পিটার, অ্যাকসেপ্টেন্স দিয়ে দিলি?’, ড্রয়িং স্পেসের কাউচে বসে, প্রৌঢ় ডঃ ম্যাকমিলান জানতে চাইলেন।
‘দেব না? বিজ্ঞানের উন্নতিতে এটুকু তো বিজ্ঞানী হিসেবে আমাদের কর্তব্য, না কী? তাছাড়া তিনটে স্টেজই তো উতরে গেছে সবগুলো। ভয় কীসের?’, হেসে বলেন ডঃ পিটার অ্যাসপেক্ট।
‘বেশ করেছিস। তা তোর কাজকর্ম কেমন চলছে?’
‘আর চলা! এই লকডাউনে সব দাঁড়িয়ে পড়েছে।’
‘দাঁড়িয়ে পড়ল? কাকে দেখে রে?’
‘ওহ্, তুমি না! এই বয়সে পারোও বটে।’
‘আরে এসবের কি আর বয়স আছে?’
‘তা বটে। আচ্ছা, তোমার এয়ার পকেট নিয়ে রিসার্চের কী হল?’
‘ছাড় তো। রিসার্চ নয়, এখন চাই রিচার্জ। ঘরবন্দি থেকে থেকে পাগল পাগল অবস্থা হয়েছে। আচ্ছা, ওই যে গোলাপী স্কার্টের মেয়েটা গেল, ওটা কে রে? চিনিস নাকি?’, প্রফেসরের চোখ চারদিকে ঘুরছে।
‘ও তো মলিকুলার বায়োলজির টিমোথি।’
‘যেই হোক, একঘর কিন্তু, কী বলিস? এয়ারপকেট এফেক্টে স্কার্টটা একটু উড়লেই…’
‘ওফ্, তুমি তো একেবারে ফিদা হয়ে গেছ দেখছি।’
‘লড়িয়ে দেব নাকি? হ্যাঁ রে, স্ট্যাটিস্টিকস কত হবে বল তো? দেখেই তো জিভে জল আসছে।’
‘অত জানি না।’
‘তো কী জানিস? পুরো টেসলা কয়েল রে মালটা।’
‘আরে ম্যাকমিলান, অ্যাসপেক্ট, তোমরা কী নিয়ে এত আলোচনা করছ?’, ডঃ অ্যান্থনি এসে ধপ করে কাউচের একদিকে বসে পড়েন।
‘এই একটু মিল্কশেক খাবার ইচ্ছে হয়েছে আর কী!’, ম্যাকমিলান হেসে বলেন। দু’জনে অনেকদিনকার চেনা জানা।
‘তা খাও না। কে বারণ করেছে? আর কেমিস্ট্রিম্যানের কী খবর?’, অ্যান্থনি ডঃ অ্যাসপেক্টের দিকে তাকিয়ে, জিজ্ঞেস করেন।
‘ওর রিঅ্যাকশন দাঁড়িয়ে গেছে, ক্যাটালিস্ট চাই।’, ম্যাকমিলান চোখ মেরে ফুট কাটেন।
‘এর মধ্যেই? ছ্যা ছ্যা।’, অ্যান্থনি মজাটায় ইন্ধন দেন।
‘দেখা যাবে আসল জায়গায়, তোমার দম আমার জানা আছে। সব তো আর তোমার অ্যাস্ট্রোফিজিক্স নয়।’, ম্যাকমিলানকে রেগে বলেন অ্যাসপেক্ট।
‘কী বললি? চ্যালেঞ্জ করছিস আমার সঙ্গে? তাহলে, হয়ে যাক বাজি। কাকে বল? ঐ গোলাপী স্কার্ট টিমোথি না ঐ ন্যানোটেকনোলজির মারিয়া? এখনও..’, ম্যাকমিলান তখন ফুটছেন। গলাটাও চড়ছে। ওপাশের বিলিয়ার্ড টেবিল থেকে দু’একজন তাকিয়েও দেখলেন।
‘আরে তোমরা ঝগড়া করছ কেন? পটাতে পারলে পটাও না, কে বারণ করেছে? এখানে তো আর কোভিডের ভয় নেই।’, অ্যান্থনি ওদের থামান।
‘সেইজন্যই তো। এবার বুড়ো হাড়ে ভেল্কি দেখাব। দেখতে চাস, পিটার?’, ম্যাকমিলান ছাড়বার পাত্র নন। লকডাউনে বন্দি থেকে থেকে, অনেকদিন পর অবশেষে প্রাণভরে আনন্দ করতে পারছেন।
‘থাক, আমার দেখে আর কাজ নেই। যা পারো করোগে।’, অ্যাসপেক্ট স্পষ্টতই বিব্রত।
‘আরে আস্তে, শেষে শুনে ফেলবে তোমাদের সব কথাবার্তা।’, ঠোঁটে আঙুল রেখে বলেন অ্যান্থনি।
‘শুনুক গে। সতী নাকি? মারিয়ার দুবার অ্যাবোর্শন হয়ে গেছে, সেটা জান?’, চাপা স্বরে বলেন ম্যাকমিলান।
‘তাই নাকি? তুমি কী করে জানলে?’, অ্যান্থনি অবাক।
‘বাজারে কান পাতলে, সব জানা যায়। এ কি আর তোমাদের প্রজেক্ট ম্যানিকুইন নাকি?’, ম্যাকমিলান ব্যঙ্গ করেন। তারপর রিমোটের কফি লেখা বাটনটা পুশ করে দেন। একটু বাদেই অটোমেটিক ফুডচ্যানেলে ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ এসে হাজির হবে।
‘আর কার কার সম্পর্কে কী কী জান বল তো? ওইদিকে ওই সোনালী চুলের সুন্দরীকে কিন্তু আমারও পছন্দ।’, অ্যান্থনি বলেই ফেলেন।
‘অ্যান্থনি, তুমিও? ও তো রেডিওলজির মিস গেলার। খুব ভাল মেয়ে।’, অ্যাসপেক্ট বলেন। দেখাই যাচ্ছে, দু’জনে খুব বাড় বেড়েছেন।
‘ভালো মেয়ে! আমি তো শুনলাম, ওর অগ্রপশ্চাৎ ডবল ডেরিভেটিভ স্যাটিসফাই করে, সেটা জানিস?’, ম্যাকমিলান লাগামছাড়া।
‘সে কী গো? চেহারাটা কিন্তু সো কিটি। তুমি আবার এদিকে নজর দিও না যেন, এটাকে কিন্তু আমার চাই।’, অ্যান্থনি মেজাজে বলেন।
‘চেষ্টা করো, তবে ও কিন্তু পুরো বিগ ব্যাং। তোমার ছোট ইউনিভার্স ওর ভেতর কোথায় হারিয়ে যাবে।’, ম্যাকমিলান আবার অ্যান্থনির পেছনে লাগেন।
‘বাজে বোকো না তো ম্যাক। ছোট, তুমি জানলে কী করে?’, অ্যান্থনি রেগে যান।
‘হা হা, দেখব কার কত দম।’, বলে কফির কাপটা আনতে যান ম্যাকমিলান। পাশের ফুডচ্যানেলে তখন গ্রিন লাইট জ্বলে উঠেছে।
‘কী আর দেখবে,অ্যাঁ? তোমাকেই বরং ও পুরো ফ্যাগোসাইটোসিস করে নেবে। হাঃ হাঃ।’, অ্যান্থনিও মজা করতে ছাড়েন না।
‘তবে বেট হোক। এই ঘরের কোন্ মাগীকে তুলতে হবে?’, ম্যাকমিলান এবার সিরিয়াস।
‘হুঃ, এ আবার একটা কথা হল? ও তো আমার বাঁ হাতের খেল, হোক বেট।’, অ্যান্থনিও তালে তাল দিয়ে বলেন।
‘ঠিক আছে তাহলে। যে পারবে, তাকে অন্যজন পেন্টহাউজ পর্ন ম্যাগাজিনের এক বছরের সাবস্ক্রিপশন গিফ্ট করবে। কি, রাজি?’, কাউচে বসে, কফিতে আয়েস করে চুমুক দিয়ে ম্যাকমিলান ওপেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন।
‘রাজি মানে, এক পায়ে রাজি।’, প্রস্তাবটা দুষ্টু হেসে লুফে নেন অ্যান্থনিও।
‘কী গো, তোমরা আবার কী নিয়ে বেট লড়ছ? আমিও একটু শুনি।’, বিলিয়ার্ড খেলা শেষ করে, কাছে এসে জানতে চাইলেন বয়স্ক নিউরোসায়েন্টিস্ট ডঃ উইলসন। এতক্ষণ আড়ে আড়ে তিনি মুখরোচক কথাবার্তাগুলো শোনার চেষ্টা করছিলেন।
‘আরে তেমন কিছু না। আপনি বুঝবেন না। এই এলএইচসিতে সূক্ষ্ম ব্ল্যাকহোল জন্মাবে কিনা এইসব নিয়ে।’, মুচকি হেসে বলেন ম্যাকমিলান।
দ্বিতীয় ঘরটাতে, যেখানে পৃথিবীর নামকরা সব পর্নস্টারদের রাখা হয়েছিল, ভাবা হয়েছিল তারা বোধহয় যৌনতা নিয়েই দিনগুলো কাটিয়ে দেবে, দেখা গেল আসলে ঠিক তার উল্টো।
‘কী রে রোজি, এখানে তো সবাই ভিড় করেছে দেখছি। ভয় করছে না?’, জ্যানেট বলে।
‘হা হা, ভয় করবে কেন? কোভিডে এতদিন যখন মরিনি, আর মরবও না। ভ্যাকসিন নিলাম তো।’, রোজ নিশ্চিন্ত মনে বলে।
‘আরে সেকথা নয়। টজারগুলো অতদিন ভুখা থাকতে পারবে তো?’ দুজনে হাত ধরাধরি করে মিনি বারের স্টুলে উঠে বসে।
‘ও, তাই বল। হা হা, তুই কি ভাবছিস এখানেই গ্যাংব্যাং, বিডিএসএম বা বুকাকে হয়ে যাবে?’, রোজ হাসতে হাসতে একটা বিয়ারক্যান খুলে বলে।
‘চুপ কর তো। ওসব কথা আর ভাল লাগেনা, টায়ার্ড লাগে।’
‘যা বলেছিস। হ্যাঁ রে, এখানে তো নতুনই বেশি, তাই না?
‘তাই তো দেখছি।’
‘এই শোন, কোণের ঐ সাদা শার্ট পরা ছেলেটাকে দেখ, কী হ্যান্ডসাম।’
‘ও তো ইভান, তোর মত অ্যামেচার করে না।’, জ্যানেটও একটা ডায়েট কোকের ক্যানে চুমুক দিতে দিতে বলে।
‘আরে সাধে কী আর অ্যামেচার করি? কী রকম কম্পিটিশন, জানিস তো! তারপর বিগ হাউজগুলোর প্রোডাকশন করোনার জন্য এখন পুরো বন্ধ। ইন্ডাস্ট্রীই প্রায় ধ্বসে গেছে।’
‘সেই তো। কতবার আর কোভিড টেস্ট করাব? তারপর আজকাল আবার নতুন নতুন সব এগ্রিমেন্ট, নতুন নতুন অ্যাডেড স্টেজ!’
‘ছাড় তো। হ্যাঁ রে, হ্যান্ডুটার নাম ইভান? এনগেজড?’
‘জানিনা রে। কথা বলে দেখব?’
‘কী সুন্দর গভীর দুটো চোখ, না রে?’
‘এই চুপ, চুপ। তোকে দেখছে।’
‘এ মা, কী ভাবল বল দেখি!’
‘কী আবার ভাববে? দাঁড়া, আমি আলাপ করিয়ে দিচ্ছি। এই ইভান, এদিকে একটু এসো তো!’
‘হাই মিল্ফ, এনি প্রবলেম?’, ইভান এগিয়ে আসে।
‘বিগ প্রবলেম। তুমি কি এনগেজড?’, জ্যানেট জানতে চায়।
‘না তো, কেন বলতো? কেউ কি জানতে চাইছিল?’, ইভান রোজির দিকে তাকাল।
‘আলাপ করিয়ে দিই, রোজ কার্টার। তোমার সঙ্গে আলাদা করে কথা বলতে চায়।’ , জ্যানেট হেসে বলে।
‘এই ছি ছি। কী বলছিস যা তা। আমি কি তোকে তাই বলেছি?’, রোজ চাপা গলায় হিস হিস করে ওঠে।
‘বলিসনি! এই যে বললি, “কী গভীর চোখ”।’, জ্যানেট হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেয়।
‘চুপ কর।’, রোজ চাপা স্বরে বলে।
‘চুপ করবে কেন, রোজ? আমি কি দেখতে খারাপ?’, মুচকি হেসে ইভান বলে।
‘না না, তা হবে কেন?’, রোজ ভীষণ লজ্জা পায়।
‘তাহলে চলো না, ওদিকে গিয়ে আলাদা করে কথা বলি। কতদিন আর সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং মেনে চলবে?’, ইভান উৎসাহী হয়ে বলে। ওরা দুজনে কথা বলতে বলতে অ্যাকোরিয়ামের দিকে এগিয়ে যায়।
‘আসি রে জ্যান।’ , বলে যায় রোজ। জ্যানেট হাত তুলে থাম্বস আপ দেখায়।
‘কী রে জ্যান, এখানেও ঘটকালি করছিস?’ ওরা চলে যেতেই এগিয়ে আসে ক্রিস্টিনা। স্টুলের ওপর চেপে বসে।
‘হা হা। আই জাস্ ওয়ানা বি পার্ট অব ইয়োর সিম্ফনি..’, জ্যানেট গুনগুন করে গেয়ে ওঠে।
‘বাবা খুব তো ফুর্তি দেখছি। আবার গানও ধরেছিস।’
‘জানিস, বন্ডেজ থেকে ছাড়া পেলেই ফিলিপের সঙ্গে বিয়েটা সেরে নেব ভাবছি। শুধু প্যান্ডেমিকের জন্য পোস্টপন্ড হয়ে আছে।’
‘তাই নাকি? তাই দেখছি ক’দিন ধরে দুজনে এত ফুসুর ফুসুর। হ্যাঁ রে, ফেসিয়াল না ক্রিমপাই?’
‘ইস, এত বাজে বকিস না!’
‘ওহ সরি, তা বিয়েতে আমাদেরও বলবি তো?’
‘আরে তোদের বলব না! তুই , রোজি, জ্যাকলিন তোদের সবার নেমন্তন্ন। এরপর তো সব খুলেও যাবে শুনছি।’
‘দারুণ। তা তোদের এনগেজমেন্ট কবে হল রে? জানতে পারিনি তো?’
‘আরে না না, এই তো ক’দিনেই হল সব। জাস্ট ভাবতেই পারছি না। জানিস, ফিলিপের ফার্মহাউসেই অনুষ্ঠানটা হবে।’
‘ও তাই? কনগ্রাচুলেশন্স, জ্যান।’
‘থ্যাংক ইউ। উফ্, আমি না এখন উড়ছি আনন্দে। ইস্, কবে যে বের হতে পারব এখান থেকে।’
‘যা বলেছিস। তা বিয়ে করবি তো মরতে ঢুকলি কেন এখানে? কন্সেন্ট ফর্মে সই করার সময় মনে ছিল না?’
‘মনে থাকবে না কেন? আসলে ফিলিপকে ক’দিন এত কাছে পাব তো, তাই রাজি হয়ে গেলাম। বাইরে থাকলে তো লকডাউনে মিট করতেই পারতাম না।’
‘ঐ তো ফিলিপ এসে গেছে। বাবা, তোকে ছাড়া থাকতেই পারে না একটুও, কী প্রেম!’, ক্রিস্টিনা আওয়াজ দেয় দুজনকে শুনিয়ে।
‘হাই ক্রিস্টিনা। জ্যান সব বলে দিয়েছে, না?’, ফিলিপ হেসে বলে। সদ্য স্নান করে আসায় ওকে দারূন ফ্রেশ দেখাচ্ছে।
‘হুঁ, কনগ্রাচুলেশন্স ফিলিপ।’, ক্রিস্টিনা হাত বাড়িয়ে দেয়।
‘থ্যাংকস’, আলতো শেক করে বলে ফিলিপ। ওর চোখে তখন নতুন জীবনের স্বপ্ন।
‘বাবা এখনো মনে পড়ে। একবার চোখে জল এসে গিয়েছিল।’ , সাদাসাপটা ক্রিস্টিনা না বলে আর থাকতে পারে না।
‘আবার ওসব কথা! বলেছি না, এখন আর এসব বলবি না, আমার শুনতে ভাল লাগে না।’, রেগে বলে জ্যানেট।
‘ও সরি, সরি। আচ্ছা বলব না। তাছাড়া তোরা এখন এনগেজড কাপল। ভুলে গিয়েছিলাম রে।’ , ক্রিস্টিনা অপ্রস্তুতে পড়ে যায়।
‘ইটস ওকে। এই জানিস, বিয়ের পরে আমাদের হানিমুন কোথায়?’, জ্যানেট উৎসাহভরে বলে।
‘কোথায় রে, পর্ণভ্যালি?’, ফুট কাটে ক্রিস্টিনা।
‘ধ্যাৎ, সুইজারল্যান্ড। এবার তো ফ্লাইটও চালু হয়ে যাবে শুনছি।’
‘ওয়াও’
তিন নম্বর ঘরে, যেখানে রাখা হয়েছিল পৃথিবীর বিখ্যাত সব কবিদের, তারা প্রেম বা কবিতার ধার ধারেননি এই ক’দিন। তারা ছিলেন একেবারে ফুরফুরে মেজাজে।
‘ওফ, এতদিনে একটু শান্তি পেলাম, কী বলিস মিক?’, রিচার্ড মদের গেলাস থেকে চুমুক দিতে দিতে বলেন।
‘একদম। তাছাড়া মোবাইল নেই বলে অন্তত পাবলিশার, মিডিয়া আর ফ্যানদের থেকে মুক্তি কটা দিন।’, মাইকেল কাউচে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে বলেন।
‘আমারও, তবে বউয়ের থেকে।’, হাসতে হাসতে বলেন রিচার্ড। ‘ভাগ্যিস এরকম একটা ভাল সুযোগ পেলাম।’
‘তা নতুন কবিতার লাইন মাথায় আসছে নাকি রিচি? তাহলে দেরী না করে লিখে ফেলো দিকি।’
‘খেপেছিস? এখন কবিতা? এখন তো খালি নেশা আর মস্তির সময়। কিন্তু এরা কিছুতেই বেশি মদ খেতে দিচ্ছে না। বলছে রেস্ট্রিকশন আছে।’
‘সব টার্ম কন্ডিশন দেখেই তো সই করেছিলে, বাবা। এখন আর বলে কী হবে? তবে সাইডএফেক্ট হয় হোক। মরি তো মরব, শালা মদ খেয়েই মরব, বিন্দাস।’, নতুন পেগ বানাতে বানাতে বলেন মাইকেল বার্নার্ড।
‘যা বলেছিস। আমাকেই দেখ না। রোজ সকালে ব্রেকফাস্ট করেই শুরু করে দিচ্ছি। যারা খায় না, তাদের কোটা থেকেও ঝাড়ছি।’
‘তাছাড়া আবার কী? আমার তো এখন বেন জনসনের “টু সিলিয়া” মনে পড়ে যাচ্ছে।’
‘আচ্ছা দেখেছিস, মার্থা আর রবিন্স কেমন মদ খেয়ে বেহেড হয়ে গেছে।’
‘শুধু মদ নয়, ওরা আড়ালে গাঁজাটাজাও টেনেছে মনে হয়।’
‘এসবও এখানে পাওয়া যাচ্ছে নাকি? তাই বাথরুমে ওরকম বিকট গন্ধ!’
‘আরে যা চাইবে, সব পাবে। এরা না দিলেই বা কী? তোমার লাগবে?’
‘ওই একটু টেস্ট করে দেখতাম আর কী। ইচ্ছে ছিল অনেকদিন ধরে। শুনেছি নিলে নাকি উড়ছি বলে মনে হয়।’
‘তা তো হয়ই। তা চাও নাকি উড়তে?’
‘সে আর বলতে? কবে থেকে তো লকডাউন আর কোয়ারান্টাইনে ঘরে বন্দি। তার ওপর পাবলিশিং হাউসগুলো প্রায় লাটে উঠে যেতে বসেছে। নতুন প্রোজেক্টে কেউ রিস্ক নিচ্ছে না। মনটাও ভীষণ খারাপ, প্রায় ডিপ্রেশনে। এইসময় উড়তে কে না চায়, বল?’
‘দাঁড়াও, দেখছি। গুড মর্নিং মিঃ নেলসন, একটু এদিকে শুনবেন প্লিজ?’, মাইকেল পাশের সোফায় বসে টিভি দেখতে ব্যস্ত নেলসনকে ডাকেন।
‘আরে কে উড়তে চাইছে, মিক? শেষে বেরিম্যান হবে নাকি?’, নেলসন সিগারে টান দিতে দিতে, ওদের পাশে এসে বসেন। বোঝা গেল, তিনি ঠারে ঠারে ওদের সব কথা শুনেছেন।
‘বলছি কী, একটা পুরিয়া জোগাড় করে দিতে পারেন? আপনার কাছে তো শুনেছি…’ , মাইকেল ইতস্তত করে বলেন।
‘দিতে পারি মিক। তবে কথা দিতে হবে আমাকে নিয়ে আর বুলিয়িং করে লিখবে না।’ , নেলসন এবারে বাগে পেয়েছেন পুরোনো প্রতিদ্বন্দ্বীকে।
‘কথা দিলাম। আর তাছাড়া, এখন আর এইসব ইঁদুরদৌড়, লবিবাজি আর পেইড রিভিউ টিভিউ ভাল লাগে না, বুঝলেন।’
‘তাহলে বুকে এসো। আজ থেকে আর কোন রেষারেষি নেই।’, নেলসন উঠে দাঁড়িয়ে, সিগারটা ঠোঁটে চেপে, দু’হাত বাড়িয়ে দেন।
‘বুকে আসুন। এই এসো না রিচি। এখন তো আর সোশ্যাল হতে বাধা নেই। সবার তো করোনা টেস্ট নেগেটিভ, আর ভ্যাকসিনও নিয়ে নিয়েছি।’ , মাইকেল নিশ্চিন্তে এগিয়ে আসেন।
‘একদম। পুরোনো ঝগড়াঝাঁটি ভুলে আজ থেকে আমরা শুধুই বন্ধু।’, রিচার্ড বলেন। তারপর সবাই সবাইকে জড়িয়ে ধরেন। হাতে ধরা মদের গ্লাস থেকে দামী মদ চলকে পড়ে।
‘আরে, তোমরা কী এত মাতলামো করছ তিনজনে? আমাকেও তোমাদের দলে নাও না প্লিজ।’, মিসেস বেইলি দেখতে পেয়ে এসে যোগ দেন।
‘মাতলামো ছাড়া আর আমরা কী পারি ম্যাডাম? আমরা তো আর আপনার মত বেস্টসেলার লিখতে পারি না! তাই মদ খেয়ে দুঃখটা একটু সেলিব্রেট করছিলাম আর কী।’, রিচার্ড কাষ্ঠহাসি হেসে বলেন।
‘আরে কীসের বেস্টসেলার? এই বাজারে কোন বিক্রিই নেই। তাছাড়া এইসব কম্পিটিশন, রয়্যালটির ঝগড়াঝাঁটি আর ভাল লাগে না, বুঝলেন?’, মিসেস বেইলি লজ্জিত হয়ে বলেন।
‘আরে আপনিও এই কথা বলছেন?’, নেলসন অবাক।
‘হ্যাঁ, এই দৌড়োদৌড়ি আর কতদিন? ক’দিন আগেই তো কোভিডে মরতে বসেছিলাম। সময়ে হসপিটালে ভর্তি হতে পেরেছিলাম বলে, কোনরকমে এ যাত্রা বেঁচে গেলাম। চোখের সামনে কত যে মানুষ এ ক’দিনে চলে গেল! কিছু করতে পারলাম?’
‘যা বলেছেন।’, নেলসন সিগারে টান দিয়ে, একটা ধোঁয়ার রিং ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে বলেন।
‘তাই এবার থেকে শুধু নিজের জন্য বাঁচব। মনে হয়, নিজের জন্য কিছু লিখি, নিজের থেকে লিখি। পারিনা, জানেন? মনে হয় অর্ডারী লেখা লিখতে লিখতে নিজস্ব সবকিছু শেষ হয়ে গেছে।’, মিসেস বেইলি ধীরে ধীরে বলেন। তার বুক থেকে বেরিয়ে আসছিল এক অব্যক্ত যন্ত্রণা।
‘আরে ভেঙে পড়ছেন কেন? দেখছেন না, আমরা নেশা করে কেমন ফুর্তি টুর্তি করছি। আপনিও করুন না। এখন না বাঁচলে আর কবে বাঁচবেন? ইয়টসের সেই লাইনটা মনে আছে তো, ‘ওয়াইন কামস ইন অ্যাট দ্য মাউথ…’, নেলসন হাসতে হাসতে বলেন। তারপর মিউজিক সিস্টেমটা চালু করে দেন।
‘ঠিকই বলেছেন। আমারও কিছু বন্ধু চাই, আমি বড্ড একা। কতদিন মাস্ক খুলে হাসিনি, কথা বলিনি। আজ তাই মন খুলে শুধু আড্ডা মারব।’, মিসেস বেইলি বলেন।
‘আর প্রেম? কবিতা? সেসবের কী হবে?’, নেলসন সিগারটা অ্যাশট্রেতে ফেলে দিয়ে জানতে চান।
‘প্রেম বলে আর আমার কিছু অবশিষ্ট নেই, মিঃ নেলসন। সব ধোঁকা।’, মিসেস বেইলি যেন কেঁদেই ফেলবেন।
‘সে কী?’
‘হ্যাঁ, চুলোয় যাক প্রেম। চুলোয় যাক কবিতা।’, মিসেস বেইলি রেগেমেগে বলেন। সেন্টার টেবিল থেকে একটা ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে, পরক্ষণেই বিরক্তিতে ছুঁড়ে ফেলে দেন।
‘শুধু বেঁচে থাক “ফ্ল্যাভিসিং ওয়াইন”। আর বেঁচে থাক ব্রাউন সুগার। কী, নেবে নাকি রিচি?’, নেলসন বলেন।
‘নেব, নেব। আজ শুধু বাঁচব। মাস্ক, ফেস শিল্ড, গ্লাভস ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, সত্যিকারের বাঁচব।’, এক চুমুকে বাকি পেগটা শেষ করে, রিচার্ড টলতে টলতে বলেন। তার দু’চোখ তখন নেশায় লাল।
‘চলো, তবে আরেক দফা হয়ে যাক।’, মাইকেলও খুশি হয়ে বলেন, দুজনেরই নেশায় তুরীয় অবস্থা।
‘অত খাবেন না মিঃ এরিকসন।’, মিসেস বেইলি অনুনয় করেন। দুজনের মধ্যে ক’দিন আগে পর্যন্ত ভীষণ রেষারেষি ছিল।
‘আরে ধুর, থামুন তো। এই নিন, আপনিও বাঁচুন এবার যত খুশি।’, ওয়াইনের বোতল এগিয়ে দিয়ে বলেন রিচার্ড এরিকসন।
‘থ্যাংক ইউ মাই ফ্রেন্ড।’, মিসেস বেইলি বোতল থেকেই চুমুক দিতে শুরু করেন।
চতুর্থ ঘরের নেশাড়ুদের অবস্থা সবচেয়ে বিস্ময়জনক। কম পরিমাণে হলেও, তাদের দেওয়া হয়েছিল সব নামী দামী মদ, একেবারে বিনামূল্যে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সেসব তারা বলতে গেলে ছোঁয়ইনি। বরং তাদের মনে ছিল ভীষণ উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা।
‘কী রে কলিন, ঘুম কেমন হল?’, কলিনের বিছানার পাশে এসে টিম রিচার্ডস জিজ্ঞেস করে।
‘দারুন, যা নরম বিছানা। বুঝলি টিম, এতদিন বোতল বোতল মদ খেলাম, সিগারেট টানলাম, মারিজুয়ানা নিলাম, তবু ঘুম এল না। আর আজ এখানে এরকম অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, মৃত্যু বা বন্দিত্ব যে কোনটা আসতে পারে জেনেও কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারছি। অদ্ভুত না?’, খবরের কাগজটা ভাঁজ করে বেডসাইড টেবিলে রেখে দিয়ে, খাটে বসে বসেই কলিন বলে ওঠে।
‘তো কন্সেন্ট দিলি কেন? বেঘোরে মরবি বলে?’, টিম একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ে।
‘কী করব! তখন অতশত তলিয়ে দেখিনি। তাছাড়া ওরকম আনলিমিটেড ওয়াইনের লোভ ছাড়া যায়! তুই বল, প্যান্ডেমিকে বার-পাবে কী রেস্ট্রিকশনটাই না ছিল! কতদিন খেতেই পাইনি।’
‘তাছাড়া ভ্যাকসিনটা তিনটে ট্রায়ালেই যখন পাস করে গেছে, তাহলে আর ভয় কী?’
‘সে তো ঠিক আছে। কিন্তু এখন শুনছি এই ঘরে নাকি ভাইরাস ছেড়ে রেখেছে। ভ্যাকসিন কেমন কাজ করে, আমাদের গিনিপিগ বানিয়ে সেটা পরীক্ষা করে দেখবে বলে। সেই শুনেই তো মদ-টদ সব মাথায় উঠল। এখন ভাবছি, ভলেন্টিয়ার না হলেই ভাল করতাম রে।’
‘ভয় পাস না। আগেও তো আমরা মরব জেনে, শুধু নেশা করার জন্যই মদ খেতাম। এত লোক কোভিডে মরল, তুই বল, মাতাল কটা মরেছে?’
‘যা বলেছিস। তবে, এবার আমাদের হ্যাপি আওয়ার। আহা, ওয়ার্ক ফ্রম হোম হবার আগে কেন যে জীবনটাকে ভালভাবে উপভোগ করে নিইনি।’
‘আমারও বড় আফসোস হচ্ছে রে। শেষে মরার সময়ে এই সত্যি কথাটা মাথায় এল! আরো ক’দিন আগে কেন যে বুঝিনি?’
‘জানিস, যদি বেঁচে থাকি, আর এই বন্দিদশা থেকে বের হতে পারি, বুঝব ভগবান আমাদের আরও ভাল কিছু করার সুযোগ দিলেন। সেই নতুন জীবনকে তখন আর ব্যর্থ হতে দেব না।’
‘আরে তোমাদের কী নিয়ে এত গভীর আলোচনা চলছে গো?’, মিঃ বেস্ট শুনতে পেয়ে পাশের আর একটা খালি চেয়ারে এসে বসলেন।
‘এই মদ খেয়ে জীবনে কত ভুল করেছি, সেইসব নিয়ে।’, কলিন টুথব্রাশে মাজন লাগাতে লাগাতে বলে। এবার ও টয়লেটে যাবে ফ্রেশ হতে।
‘ভুল তো বটেই। মনে হয়, হুইস্কির ফোঁটাগুলো সব যেন লেগটিয়ার্স নয়, চোখের জল হয়ে বেরিয়ে আসছে।’ টিম আফসোস করে।
‘আসবেই তো। আগে মনে হত দুঃখে মদ খাই, আনন্দে মদ খাই। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে দুঃখ আর আনন্দ হাত ধরাধরি করে এই বিশাল জগৎ সাঁতরে পার হতে জানে।’, হ্যারিসন বেস্ট আস্তে আস্তে বলেন। এই মহামারীতে তিনি নিজের স্ত্রীকে হারিয়েছেন, মাত্র কিছুদিন আগে।
‘এ আপনি কী বলছেন?’, টিম অবাক। সে সোসিওলজীর ভাল ছাত্র ছিল। কবিতা লিখত, একটা ব্যান্ডও ছিল। কিন্তু প্রেমিকা ধোঁকা দেবার পর থেকেই আস্তে আস্তে মদ-গাঁজায় আসক্ত হয়ে পড়ে।
‘বলব না! মনে পড়ছে, কত রাতে মদের ঘোরে বাড়ি ফিরিনি, পাবক্রল করেছি, তারপর রাস্তায়, নর্দমায় পড়ে বেহুঁশ হয়ে থেকেছি। এখন মনে হয় সেই সব রাতগুলো যদি লেকের ধারে বসে, চারপাশে জ্যোৎস্নার ভেসে যাওয়া দেখতাম! ঘাসের বিছানায় শুয়ে যদি আকাশের নক্ষত্ররাশী দেখতাম!’, বেস্ট যেন কবি হয়ে গেছেন।
‘তাহলে কি আমাদের জীবনটা ফল্টি আর ওয়েস্টেড হয়ে গেছে, বলতে চান?’ ,টিম জানতে চায়।
‘তা কেন হবে? শুধু ডাইমেনশনটা পাল্টাতে হবে। ফোর্থ আর ফিফ্থ ডাইমেনশন পাল্টে গেলে পুরোনো জীবনকে ফিরে পাওয়া যায়।’, বেস্ট যেন তখন বিজ্ঞানী। অনেকেই বলে, মানুষটার অনেকদূর পড়াশোনা। কিন্তু মদ ছাড়া একটা দিনও থাকতে পারেন না।
‘বলেন কী? এখনো তাহলে লাস্ট কলের সময় হয়নি?’
‘বলছি তো। আশা ছেড়ো না। শুধু দুনিয়াটাকে দেখতে শেখো।’
‘কী দেখব বলুন তো? বাঁচব ক’দিন তার ঠিক আছে?’
‘তা বলে কি দেখবে না? মানুষ হয়ে জন্মেছি কী জন্য?’
‘মানুষ! ছ্যা ছ্যা। ভগবান আমাদের কত দুর্বল করে তৈরি করেছেন, বলুন তো! ছোট্ট একটা করোনা ভাইরাসের কাছে আমরা একেবারে অসহায়। অথচ আমরা ভাবি আমরা বুঝি সর্বশক্তিমান।’
‘কিন্তু আমাদের যে মন আছে। তাই তো আমরা সবার থেকে আলাদা, আমরা দুনিয়া বদলাতে পারি।’
‘তা হয়ত পারি। কিন্তু তা কার জন্য? ভালর জন্য?’
‘আলবাত। পৃথিবীর ভালর জন্য।’
‘কিন্তু প্রকৃত ভালটা আসলে কী, মিঃ বেস্ট?’, টিম স্পষ্টতই কনফিউজড।
‘শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকা। এই কোভিড মহামারী মানুষ জয় করবেই, দেখে নিও। এটাই তো ভগবানের লীলাখেলা।’
‘লীলাখেলা আর থাকছে কই? সবটাই তো হ্যাংওভার। চাকরি-ব্যবসা সব লাটে উঠেছে, ইকোনমি ধ্বসে গেছে, রোজকার একেবারে বন্ধ। সব ভুলেভালে-তালেগোলে চলেছে।’
‘ভগবানে ভরসা রাখো। তিনি আগে থেকেই সব ব্লু লওজ ঠিক করে রেখেছেন। শুনেছি, একশোটা হাইড্রোজেন বোমা ফাটালে গোটা পৃথিবীই ধ্বংস হয়ে যাবে। অথচ সূর্যে প্রতি সেকেন্ডে কত লক্ষ হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণ হচ্ছে, কিন্তু তার আঁচ তো পৃথিবীতে এসে পৌঁছচ্ছে না!’
‘ইটস জাস্ট বাই এ চান্স।’
‘না গো। আমার তো মনে হয়, কে যেন রহস্যময়ভাবে অনেক ম্যাথমেটিক্স কষে, আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। সবকিছু এক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দিকে এগিয়ে চলেছে। এমনকি ভাইরাসটাও।’, বেস্ট কোন এক উপলব্ধির কথা বলতে চান।
‘আমি অত বিজ্ঞান ফিজ্ঞান বুঝি না, ভগবানও মানি না। মরব জেনেও ভ্যাকসিনের ট্রায়ালে রাজি হয়েছি, এখানে এসে থেকে মদ জুয়া সব ছেড়ে দিয়েছি। আজ আমারও মনে হয় সব ম্যাথমেটিক্সই আসলে এথিক্স।’, কলিন এতক্ষণে মুখ ধুয়ে এসে বলে। ওদের সব কথাই ওর কানে গেছে।
‘ঠিক কথা।’, বাকি দুজনও সহমত হয়।
অবশেষে পনেরো দিনের সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা সারা হল। সকলের সমস্ত রিপোর্ট দেখে, শেষে বন্দি মানুষগুলোকে সসম্মানে, আবার যার যার নিজের দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু কথোপকথনের রেকর্ডিংগুলো ভালোভাবে বারবার দেখে-শুনে অপারেশন আপসাইলনের কর্মকর্তারা একেবারে তাজ্জব হয়ে গেলেন। খুব অদ্ভুত সব তথ্য বেরিয়ে এল ওদের এই প্রোজেক্ট থেকে।
বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞান বা উচ্চতর দর্শন নিয়ে খুব একটা নয়, বরং যৌনতা নিয়েই বেশি উৎসাহী ছিলেন। বিজ্ঞানের তর্ক-বিতর্ক দূরে সরিয়ে রেখে, নিজেদের যৌন আকাঙ্ক্ষা মেটানোই ছিল তাদের মাথাব্যথা। পর্নস্টাররা দেখা গেল উল্টো। যৌনতা নিয়ে তারা ছিল বেশ তিতিবিরক্ত। প্রকৃত প্রেমই হল তাদের মতে জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া, যা তারা কখনও পায়নি। তাই তারা ওই ক’দিনের পরিসরেই বেছে নিতে চেয়েছে পছন্দের মানুষটিকে। কবিরা দেখা গেল, প্রকাশনার চাপ, লবিবাজী আর খ্যাতির ইঁদুরদৌড় নিয়ে ভীষণ রকম বীতশ্রদ্ধ। তারা এই ক’দিন একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে চেয়েছেন। নিজেদের মত করে জীবনটা নেশা করে আর আড্ডা মেরে কাটিয়ে দিয়েছেন, খুশিতে উড়তে চেয়েছেন। যেদিন পরীক্ষা শেষ হল, দেখা গেল যে, তাদের অনেকেই এত বেশি নেশা করেছেন, যে সোজা হয়ে হাঁটা তো দূরস্থান, নিজেদের নাম ঠিকানা পর্যন্ত ঠিকঠাক বলতে পারছেন না। অথচ যাদের আসলে নেশায় ডুবে থাকার কথা, সেই সব মাতালরা নেশা করা নিয়ে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে, এক নতুন জীবনের সন্ধানে ভেসে গিয়েছিল। তারা বিভিন্ন তত্ত্বকথা নিয়ে আলোচনা করছিল, যার মধ্যে উচ্চতর বিজ্ঞান আর দার্শনিক উপলব্ধিই ছিল বেশি। ছাড়া পেয়ে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিল তারাই। পুনর্জন্ম পাবার আনন্দে খোলা প্রকৃতির মাঝে দাঁড়িয়ে, তাদের কেউ কেউ নাচছিল, কেউ গান গাইছিল, কেউ বা খুশিতে পাগল হয়ে, প্রিয়জনদের ফোন করে আনন্দে কেঁদে ফেলেছিল।
এরকম অদ্ভুত একটা রিপোর্ট সামনে আসায়, অপারেশন আপসাইলনের কর্তারা পুরোপুরি হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেন। ভ্যাকসিনের সাইড এফেক্টে, মানুষের চরিত্র বদলে যাচ্ছে নাকি? এরকমটা তো হবার কথা নয়! অন্তত প্রথম তিনটে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে এরকম কোন আভাস পাওয়া যায়নি। তখন অবশ্য এভাবে স্টাডি গ্রুপগুলোর কথোপকথন পরীক্ষা করে দেখা হয়নি। তাছাড়া এদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরীতেও কোন মিল নেই। সুতরাং কিছু মেলাতে না পেরে, ওরা শেষ পর্যন্ত পুরো পরীক্ষাটাকেই বাতিল বলে ঘোষণা করে দিলেন। যুক্তি দেওয়া হল এই যে, কোন ভ্যাকসিনের সাফল্য শুধু তার গুণাগুণের ওপর নয়, যাকে দেওয়া হচ্ছে তার চারিত্রিক ধরন আর মানসিক গভীরতার ওপরও নির্ভর করে।
তারা ঠিক করলেন, পরীক্ষাটা আরো একবার করা দরকার, তবে একটু অন্যভাবে। এবারের পরীক্ষায় আলাদা চার ধরনের মানুষকে নিলেও, তাদের মিলিয়ে মিশিয়ে চারটে ঘরে রাখা হবে। বাকি সব নিয়ম অবশ্য একই থাকবে। এবারে নিয়ে আসা হল বিখ্যাত সব ধর্মগুরুদের, নামী খেলোয়াড়দের, সারা পৃথিবীর দুঁদে সব রাজনীতিকদের এবং মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদের।
সেই পরীক্ষা চলছে, এখনো শেষ হয়নি। তবে তার ফলাফল শিগগিরই প্রকাশ হল বলে।