অদ্বিতীয়া || অরুনা চক্রবর্তী

টুকটুকির মনটা কেমন উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। ঠিক বিনু জেঠিমার বাগানের সেই হালকা সবজে নীল লাল নকশা করা প্রজাপতিটার মতো! মনের আনন্দে রঙ ছড়িয়ে হলুদ সূর্যমুখী ফুলটার কাছে উড়ছিল। যেমন ও এখন বুকের কাছে চেপে ধরা ব্যাগটা থেকেও সেরকম আনন্দ অনুভব করছে। ভাবতে ভাবতে ব্যাগটা আরও জোরে বুকের কাছে চেপে ধরল… ” আঃ কী মজা!” কাল ষষ্ঠী। দুর্গা মায়ের পুজো শুরু। কল্পনায় ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল টুপাই, রীনা, কুচকা, রাকা সবার সঙ্গে ও দুর্গা মায়ের সামনে ঢাকের তালে তালে নাচ করছে। আর ওর পরনে বিনু জেঠিমার দেওয়া লাল টুকটুকে জামা! প্যান্ডেলের সবাই ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে, ও রানীর মতো বুক ফুলিয়ে আড় চোখে দেখছে সেই বড় মাঠের কোণে প্রাসাদের মতো বড় ইস্কুলে যাওয়া পাড়ার বড় বড় বাড়ির বাচ্চাদের অবাক দৃষ্টি।

“টুকি ই ই.. গাড়ি আসছে। দেখে রাস্তায় হাঁটো… হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবে“- মায়ের জোরে বকুনিতে ও সম্বিত ফিরে আরও জোরে ব্যাগটা বুকে চেপে ধরল। পড়ে গিয়ে যদি ব্যথা পায় তাহলেও কোনো দুঃখ হবে না কিন্তু ব্যাগের জামায় কোনভাবেই ধুলো লাগতে দেবে না টুকটুকি।

টুকটুকি মায়ের হাত ধরে বস্তিতে কখন ঢুকেছে তার খেয়ালই নেই। মা ওর হাত মুখ ধুয়ে উঠোনে ঘুঁটে কয়লা দিয়ে উনুন ধরিয়ে জল আনতে চলে গেল।

পুরো উঠোনটা ধোঁয়ায় ভরে গেছে সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। ও যেন স্বপ্নরাজ্যেই উড়ে বেড়াচ্ছে। উনুনের কালো ধোঁয়া কখন সাদা তুলোর মতো মেঘ হয়ে গেছে আর ও লাল টুকটুকে জামা গায়ে ভাসছে। চারিদিকে নীল আকাশ তার মধ্যে সাদা তুলোর মতো হালকা হালকা মেঘে চড়ে ও ভাসছে।

আরে..! ওই তো, সেই প্রজাপতিটা… হলুদ সূর্যমুখী ফুলটাওতো রয়েছে। বাহ্, সূর্যমুখী ফুলটা ধীরে ধীরে বিনু জেঠিমার মুখ হয়ে গেল! ওর পিঠে দুটো পাখা– ওম মা… এ তো সেই রঙিন প্রজাপতিটার পাখার মতো! ও লাল জামা আর সবুজ– লাল ছোপের পাখনা নিয়ে ভ্রূক্ষেপ নেই উড়ে বেড়াচ্ছে। এখানে সূর্যটা কত ঝকমকে, কত উজ্জ্বল। চারিদিকে খুশির জোয়ার বইছে। মনের ভেতরে হাজার হাজার ঢাকের বাদ্যি বাজছে তালে তালে ছন্দে ছন্দে– আনন্দে আত্মহারা ও।

“টুকটুকি! ওঠ– খাবি… দেখ! মেয়ে কেমন ঘুমিয়ে কাদা হয়ে আছে। ওঠ মা, দুটো মুখে দে।”

মায়ের ডাকে উঠে চোখ কচলে দেখছে চারিদিক অন্ধকার আর টুকটুকি উঠোনে খাটিয়াতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাড়াতাড়ি খেয়েই শুয়ে পড়ল। কাল যে ষষ্ঠীপুজো!

মা দুর্গা সেই এক বছর পর এল। এই ক’দিন ওর মা কাজে যাবে না। ও মন্ডপে মন্ডপে ঘুরবে, আনন্দ করবে মায়ের সঙ্গে– বস্তির বন্ধুদের সঙ্গে। মা কাজে বেরোলে ওর একদম ভালো লাগে না। তাই দুর্গা মাকে ওর এত্ত ভালো লাগে, কেন যে উনি সারাবছর বাপের বাড়ি থাকেন না কে জানে!

মাথার কাছে বালিশের পাশে জামার ব্যাগটা রেখে একটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে রেখেছে– তাতেও যেন আনন্দ। ভাবতে ভাবতে কখন দু’চোখে ঘুম নেমে এসেছে। সারা রাত দুর্গা মায়ের হাসি হাসি মুখ, ঢাকের বাদ্যি, ধূপ ধুনো, কত লোক… ও লাল জামাটা গায়ে কত নাচ করছে, গান গাইছে।

জানলার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো চোখে এসে পড়তে ঘুম ভেঙে গেল। মাথার কাছ থেকে ব্যাগটা নিয়ে এক লাফে দাওয়ার বাইরে এসে দু–তিন বার গোল করে ঘুরে ঘুরে নেচে নিল।

মা সকালে উনুন ধরিয়েছে। ওর হাতে দশটা টাকা দিয়ে গলির মুখে বড় রাস্তায় দিনু কাকার দোকান থেকে মুড়ি আর বিস্কুট নিয়ে আসতে বলল।

ও লাফাতে লাফাতে চলল সেখানে। দুর্গা মায়ের পুজো শুরু তাই চারদিকে মাইকে মহালয়া, দুর্গা মায়ের গান বেজেই চলেছে। একটু পরেই লাল জামাটা গায়ে ও মন্ডপে যাবে– আনন্দে মাইকের গানের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গুন গুন করে ”ঢাক বাজা কাঁসর বাজা… বল বল দুগ্গা এল।” গাইতে গাইতে লাফাতে লাফাতে চলল দোকানে।

দিনু কাকার দোকান থেকে মুড়ি আর বিস্কুট কিনে বাড়ি ফেরার জন্য পেছন দিকে ঘুরতেই দেখল একটা ছোট বাচ্চামেয়ে –ওরই মতো বয়স হবে, শতছিন্ন জামা গায়ে রাস্তার ধারে বসে ভিক্ষে করছে, মুখটা ভীষন শুকনো।

ওর মনটা খারাপ হয়ে গেল– হঠাৎ করে হাজার পাওয়ারের আলোটা নিভে গিয়ে মনে হচ্ছে চারিদিকে অন্ধকার নেমে এল। হাতের বিস্কুটের প্যাকেটটা মেয়েটাকে দিয়ে বলল, “একটু দাঁড়া। আমি এক্ষুনি আসছি।“

ছুটতে ছুটতে সোজা ঘরে ঢুকে ওর লাল জামার ব্যাগটা নিজের জামার নিচে লুকিয়ে, মা যেন দেখতে না পায় তাই চুপি চুপি বেরিয়ে ছুটে গলির মুখে বড় রাস্তায় সেই মেয়েটার কাছে চলে এল।

মেয়েটা তখনও দাঁড়িয়ে আছে ওখানে বিস্কুটের প্যাকেট হাতে।

হাঁপাতে হাঁপাতে ওর হাতে জামার ব্যাগটা দিয়ে বলল, “খোল– খুলে দেখ! এটা একটা লাল জামা। এটা গায়ে দিয়ে মন্ডপে দুর্গা মায়ের কাছে যাবি, ঢাকের তালে নাচ করবি… কেমন!”

মেয়েটি ব্যাগ হাতে অবাক হয়ে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ওর দিকে।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত গলায় চন্ডী স্তোত্র ভেসে আসছে- “যা দেবী সর্ব ভূতেষু দয়া রূপে ন সংস্থিতা ….. নমো নমঃ” মা দুর্গা ছোট মেয়ের রূপ ধরে যেন এখানেই এসেছেন… আজ মায়ের বোধন এখানে হল।

টুকটুকি মায়ের হাত ধরে মন্ডপে এসেছে গত বছরের জামাটা পরেই। ওর মা প্রথমে রাগ করেছিল যদিও, কিন্তু ও যখন বলল,”মা–ওই মেয়েটার জামা ছেঁড়া, একদম ফুটো ফুটো হয়ে গেছে তাই তো দিলাম ওকে।” মা আর কিছু বলেনি শুধু চুপ করে কেমনভাবে যেন ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিল কিছুক্ষণ।

টুকটুকি অঞ্জলি দেবার সময় প্রণাম করে যেই দুর্গা মায়ের মুখের দিকে তাকাল– ওমা! দূর্গা মা যে ওর দিকেই তাকিয়ে কেমন মিটিমিটি হাসছে। যেন ওকে বলেছে “খুব ভালো মেয়ে তো তুই, আজ কিন্তু বেশ ভালোই  কাজ করেছিস “- সেই হাজার পাওয়ারের আলোটা হঠাৎ আবার জ্বলে উঠল, চারিদিকে আলোর মালায় খুশিতে ঝলমল করে উঠল ওর মনটা এক অজানা আনন্দে– আত্মহারা হয়ে নেচে উঠলো ঢাকের তালে তালে… ঢ্যাং কুড়্ কুড়্ ঢ্যাং কুড়্ কুড়্।

Leave a Reply

Your email address will not be published.